ঢাকা সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫

পুলিশ কর্মকর্তার উদ্যোগে আবারও বিদ্যালয়ে ফিরল সুরাইয়া

গজারিয়া (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২৫, ০৫:১০ পিএম
শিক্ষার্থী সুরাইয়া আক্তারের হাতে বই তুলে দেওয়া হয়। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার টেংগারচর ইউনিয়নের মধ্য ভাটেরচর গ্রামে বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুরাইয়া আক্তার (১৭)। পরিবার থেকে বিয়ের চাপ এলেও নিজের ভবিষ্যৎ ও পড়াশোনার স্বপ্নকে প্রাধান্য দিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পুলিশের শরণাপন্ন হয় মেয়েটি। পরে গজারিয়া থানা পুলিশের এক কর্মকর্তার মানবিক উদ্যোগে সুরাইয়া আবারও বিদ্যালয়ে ফেরার সুযোগ পায়।

সুরাইয়া আক্তার ভাটেরচর ইসলামিয়া দাখিল ও আলিয়া মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্রী। তার পিতা আবুল হোসেন ওরফে সজিবুর রহমান (৫০) একজন দিনমজুর। মা ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সুরাইয়া সবার বড়। মেঝ ভাই আব্দুল্লাহ (১২) স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে এবং ছোট ভাই আব্দুর রহমান (৬) প্রথম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।

তাদের বসবাস টেংগারচর ইউনিয়নের মধ্য ভাটেরচর গ্রামের শেষ প্রান্তে কৃষিজমির পাশে ছোট একটি টিনের ঘরে। দিনমজুর বাবার স্বল্প আয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে অনেক আগে থেকেই। সংসারের টানাপোড়েনে একপর্যায়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে কিছুটা স্বস্তি পাবেন, এমন আশায় সুরাইয়ার বাবা-মা বিয়ের উদ্যোগ নেন। কিন্তু এতে বাধা দেয় মেয়েটি নিজেই। সুরাইয়া দৃঢ় কণ্ঠে জানায়, সে এখন বিয়ে করবে না, পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায়। পরিবার রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সে নিজেই গজারিয়া থানা পুলিশের শরণাপন্ন হয়।

ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে নেয় গজারিয়া থানা প্রশাসন। ওসি আনোয়ার আলম আজাদের নির্দেশে থানার সেকেন্ড অফিসার বিজন বাড়ৈ ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন, দুই রুমের ছোট একটি ঘরে চলছে দরিদ্র পরিবারের কঠিন জীবনযুদ্ধ। তদন্তে বিয়ের ঘটনার সত্যতা মিললেও জানা যায়, আর্থিক অনটন ও অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যয় সামলাতে না পেরে মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পিতা।

এই সময় সুরাইয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘স্যার, আমি পড়াশোনা করতে চাই। এখন আমি বিয়ে করব না। আমার বাবা-মায়ের কোনো দোষ নেই, তারা কষ্টে আছেন। আমি শুধু পড়তে চাই।’

এমন অনুপ্রেরণাদায়ক কথায় নাড়া দেয় থানার মানবিক পুলিশ কর্মকর্তা এসআই বিজন বাড়ৈর মন। পরে তিনি নিজ উদ্যোগে সুরাইয়ার জন্য নোটবুক, খাতা, কলমসহ পড়াশোনার প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দেন এবং ভবিষ্যতে পড়াশোনায় সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন গজারিয়া থানার কনস্টেবল সুজন রায়।

গজারিয়া থানার ওসি আনোয়ার আলম আজাদ বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি যাতে কোনো মেয়েই বাল্যবিবাহের শিকার না হয়। সুরাইয়ার মতো মেয়েরা যদি এগিয়ে আসে, তবে সমাজে বড় পরিবর্তন আসবে।’

এসআই বিজন বাড়ৈ জানান, ‘তদন্তে এসে তাদের পরিবারের সবকিছু কাছ থেকে জানার সুযোগ হয়। আর্থিক অনটন ও অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যয়, তাদের পড়াশোনার খরচ সামলাতে না পেরে মেয়েটির বিয়ের পরিকল্পনা করছিল পরিবার। সুরাইয়াকে নিজের বোনের মতো মনে হয় আমার। সে জন্য তার পড়াশোনার জন্য বই, খাতা, কলম কিনে দিয়েছি এবং তার এসএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত পড়াশোনার সকল খরচ আমি বহন করব।’

স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশের এমন মানবিক উদ্যোগের প্রশংসা করেন। তাদের মতে, এই ধরনের উদ্যোগ শুধু একটি মেয়েকেই নয়, গোটা সমাজকে সচেতন করবে।