বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকেই মাঠে পর্যায়ে আগের মতো সক্রিয় নেই পুলিশ। আর এ সুযোগে খুলনায় সরব মাদক কারবারিরা। গত কয়েক
বছরে গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল ও মদের মতো মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে মাদকের ছোট-বড় চালান ধরা পড়লেও থেমে নেই রমরমা এ ব্যবসা। দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গেলো এক মাসে সব কিছুর অবনতি হলেও, হয়নি মাদকের ভয়াবহতা। বরং বেড়েছে কয়েকগুন। সাম্প্রতিক সময়ে মাদককে কেন্দ্র করে মহানগরে বেড়েছে খুনাখুনি।
অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ এই ব্যবসায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশাসনের গোপন সহযোগিতাও পেয়ে আসছেন মাদককারবারিরা। আর পট পরিবর্তনের সাথে সাথে
হয়েছে হাতবদল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে ১৬৭টি ও মেট্রোপলিটনের ৮ থানায় ৭৪৪টি মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়েছে। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যা মোট মামলার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ।
খুলনা সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের সভাপতি কুদরাত-ই-খুদা বলেন, আইন, সমাজ ও রাজনৈতিক সমন্বয়হীনতায় বাড়ছে মাদক নামক সামাজিকব্যাধি। খুলনায় হাত
বাড়ালেই পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। এ মাদক ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা সামাজে কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক ও একশ্রেণির প্রভাবশালীর
আশ্রয়ে এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। মূলত ওইসব গডফাদাররা বরাবরই ধরাছোয়ার বাইরে থাকছে।
খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এসব মাদকের চালান আসে সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা, যশোর ও কুষ্টিয়া দিয়ে। অপরদিকে ইয়াবার চালান
আসে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী পরিবহণের মাধ্যমে। অর্থের লোভে মাদককারবারে জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন পরিবহনের চালক ও হেলপাররাও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেটকার, যাত্রীবাহী বাস অথবা পণ্যবাহী ট্রাকের একশ্রেণির চালক-হেলপাররা সীমান্ত এলাকা থেকে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য
নিয়ে আসছেন।
খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসের বিভিন্ন অভিযানে ১৮২ জনকে আসামি করে ১৬৭টি মামলা করা হয়েছে। আর
আলামত হিসেবে ১০৭ কেজি ২৪৫ গ্রাম গাঁজা, ৩৮৪১ পিস ইয়াবা, ১৩৮ বোতল ফেনসিডিল, ১০৪৫ পিস টেপেন্ডা, ৩০ লিটার জাওয়া, ৭ লিটার চোলাই মদ, ২.৮
লিটার অ্যালকোহল উদ্ধার করা হয়। একইসাথে মাদকের কাজে ব্যবহৃত ২টি মটরসাইকেল, ১টি মেমোরিকার্ড এবং মাদক বিক্রির ৪ লাখ নগদ টাকা জব্দ করা
হয়। এর আগে ২০২২ সালের ছয় মাসে ১০৬৪ অভিযানে ১৮৪ টি মামলায় ১৯২ জনকে আসামি করে করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ২০২৩ সালে ১৯৬৪টি অভিযান পরিচালনা করে ৩২৭ মামলার আসামি করে ৩৬৫ জন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, গত কয়েক বছরে ইয়াবার মতো সহজে বহনযোগ্য মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে
খুলনাঞ্চলে। পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়েও মাদককারবারির সংখ্যা বেড়েছে। মাদক বিক্রির কৌশল পরিবর্তন হওয়ায় এবং গোয়ান্দা সংস্থার মতো আমাদের ডিজিটাল
ডিভাইস ও মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় আলামতসহ অপরাধী আটক বেশ চ্যালেঞ্জিং। তাছাড়া উপজেলা পর্যায়ে আমাদের কোনো অফিস নেই। জেলা থেকেই দেখতে হয় এতে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এরপরও আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মাদককে কেন্দ্র করে খুলনায় বেড়েছে হত্যার ঘটনা। গত কয়েক বছরে ইয়াবার মতো
সহজে বহনযোগ্য মাদকের বিস্তার ঘটেছে। গত ৯ জুলাই রাতে ২৭ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আল আমিনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
প্রাথমিক তদন্তে মাদকের অর্থ ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তারে এ হত্যা বলে জানায় পুলিশ। এর আগে একই ঘটনায় গত ২৮ মে ৩০নং ওয়ার্ডের খ্রিস্টান পাড়ায় রনি
সরদার ও ২৩ জানুয়ারি ময়লাপোতা মোড়ে সাদিকুর রহমান রানাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া গত বছরের ৫ আগস্ট সোনাডাঙ্গা এলাকায় শীর্ষ দুই
মাদকব্যবসায়ী গ্রুপের গোলাগুলিতে খুন হন ইমন শেখ এবং ৫ অক্টোবর গোবরচাকা এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের
শিক্ষার্থী মো. ইমন শেখ।
মাদকবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনাকারী একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে, খুলনা নগরে গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, চোলাই ও দেশি মদের শতাধিক স্পটের পাশাপাশি ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। প্যাথেডিন, লুপিজেসিক, সিডিল, টিডিজেসিক ও নেলবন ইনজেকশন শরীরে পুশ করে নেওয়া হয়। এসব মাদকসেবীদের বেশিরভাগই তরুণ, যুবক ও ছিন্নমূল। নয়টি উপজেলা পর্যায়েও রয়েছে এরকম মাদকস্পট। আর ভবঘুরে, ছিন্নমূল মাদকসেবীদের একটি
অংশের অবস্থান খুলনা রেলস্টেশন ঘিরে। এদেরকে মাদক বিক্রি, পরিবহন ও খুচরা বিক্রির কাজেও ব্যবহার করছেন নেপথ্যের হোতারা।
অভিযোগ রয়েছে, মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে মাদকের ছোট-বড় চালান ধরা পড়লেও থেমে থাকে না অবৈধ এ ব্যবসা। এসব ঘটনায় শুধু মাদক
বহনকারী ইজিবাইকচালক, কিশোর-তরুণ, বেকার যুবকসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ ধরা পড়ে। এর বাইরে বিভিন্ন সময় দরিদ্র মাদকসেবীদের আটক করা হয়। তবে
মাদক পাচারের মূল হোতাদের খুঁজে বের করতে পারে না পুলিশ।
আপনার মতামত লিখুন :