দেশের সীমান্তঘেষা জনপদ সিলেটের জকিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনা এখন নিত্যদিনের ঘটনা। জেলা শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ জনপদের সড়কগুলোতে দিন দিন বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা।
জকিগঞ্জের রোড এক্সিডেন্ট সার্ভে সেল 'সড়কনজর' এর তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত সিলেট-জকিগঞ্জ মহাসড়ক ও উপজেলার বিভিন্ন ফাঁড়ি রাস্তায় অন্তত ১৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজনই শিশু।
তবে অনেক স্থানীয়রা বলছেন, এ সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে।
রোববার (১৯ জানুয়ারি) বাবুরবাজারে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মায়ের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার সময় রাস্তা পার হতে গিয়ে টমটমের ধাক্কায় আহত হয় জুবের আহমদের ছেলে ইউসুফ খান (০৯) জকিগঞ্জ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর বাসায় নেওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে পুনরায় হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে উপজেলার জামুরাইল গ্রামে ট্রলি গাড়ি থেকে পড়ে মারা যায় সাত বছরের শিশু রাহিম আহমদ।
স্থানীয়রা জানান, চলন্ত ট্রলিতে শিশুদের সঙ্গে রাহিমও খেলছিল; হঠাৎ নিচে পড়ে তার মৃত্যু হয়।
১৮ জুন বিকেলে ইউনিয়ন অফিসবাজার এলাকায় মাইক্রোবাস ও টমটমের সংঘর্ষে টমটমচালকসহ দুইজন নিহত হন। আহতদের মধ্যে সাব্বির আহমদের ছেলে মুরসালিন (৭) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
২৫ আগস্ট বিকেলে সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের দেওয়ানচক এলাকায় দশসিটা গাড়ির ধাক্কায় সীমান্তিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইকরা হাবিব (৬) নিহত হয়। সে দেওয়ানচক গ্রামের প্রবাসী হাবিবুর রহমানের বড় মেয়ে।
১০ নভেম্বর বিকেলে মুমিনপুর গেটের সামনে ব্যাটারিচালিত টমটমের ধাক্কায় মারা যায় কুসুম কলি কিন্ডারগার্টেনের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রাইয়ান হোসেন (৮)। সে মুমিনপুর গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুছ ছালাম ছলন মিয়ার ছেলে।
সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারে জকিগঞ্জ উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি জুবায়ের আহমদ বলেন, মাত্র এক বছরে সড়কে ১৩টি প্রাণ হারানোর মধ্যে পাঁচটি শিশুর মৃত্যু জকিগঞ্জবাসীর জন্য গভীর সতর্কবার্তা। এটি শুধু দুর্ঘটনা নয়, আমাদের সড়কনিরাপত্তা ব্যবস্থার চরম ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক ও উপজেলার ফাঁড়ি রাস্তাগুলোয় লাগামহীন গতি, অদক্ষ চালক ও অবহেলিত অবকাঠামো আজ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। এখনই যদি প্রশাসন, স্থানীয় সরকার ও সাধারণ মানুষ মিলে সচেতনতা ও কঠোর নজরদারির উদ্যোগ না নেয়, তবে এই প্রাণহানির মিছিল থামবে না। আমরা চাই ‘নিরাপদ সড়ক’ শুধু স্লোগান নয়, জকিগঞ্জবাসীর বাস্তবতা হোক।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়ে জকিগঞ্জ মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন হায়দার বলেন, সড়কে এভাবে প্রাণহানি ঘটতেই থাকবে আর প্রশাসনসহ সবাই নিরবতা অবলম্বন করে হত্যার লাইসেন্স দিয়ে যাবেন তা কোনও ক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
এ ব্যাপারে অবিলম্বে দ্রুত নিরাপদ সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থায় আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সড়ক বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চাই। আশা করা যায় সার্বিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি হলে এবং আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পার পাওয়া যায় না। এমন ধ্রুব সত্যকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলে ইনশাআল্লাহ এমন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা অনেকাংশেই এড়ানো সম্ভব হবে বলে বিশ্বাস করি।
সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজের শিক্ষার্থী আবীর আল নাহিয়ান বলেন, জকিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা পারাপারের কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই। কোথাও জেব্রা ক্রসিং নেই, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেগুলোর সামনেও স্পিডব্রেকার নেই। ফলে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
অন্যদিকে ব্যাটারিচালিত টমটম ও বিভিন্ন যানবাহনের চালকদের মধ্যে অনেকেই অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অদক্ষ। এতে সামান্য অসতর্কতাতেই ঘটছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি।
জকিগঞ্জ থানার ওসি জহিরুল ইসলাম মুন্না বলেন, আমরা ইতিমধ্যে পরিবহন শ্রমিক ও এলাকার রাজনীতিবিদের সাথে কথা বলেছি। জনসাধারণকে সচেতন করতে প্রত্যেক ইউনিয়নে সভা করেছি যা এখনো অব্যাহত আছে।


