বাংলাদেশের আসবাব শিল্পে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা একটি প্রতিষ্ঠান ব্রাদার্স ফার্নিচার। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠানটি দেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে মানসম্মত আসবাব সরবরাহ করে আসছে। শুধু ব্যবসায়িক পরিধি নয়- প্রযুক্তি, ডিজাইন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার দিক থেকেও ব্রাদার্স ফার্নিচার আজ এক অনন্য অবস্থানে পৌঁছেছে।
ব্রাদার্স ফার্নিচারের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮১ সালে। মো. হাবিবুর রহমান সরকার এবং তার ভাই ইলিয়াস সরকার যৌথভাবে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এরও আগে, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, প্রতিষ্ঠানটি ‘ভাই ভাই ফার্নিচার’ নামে পরিচিত ছিল, যা ছিল একটি ক্ষুদ্র পরিসরের কাঠের আসবাব নির্মাণ ও বিক্রয়কেন্দ্র।
প্রাথমিক পর্যায়ে কাঠের খাট, আলমারি, চেয়ার এবং টেবিল তৈরির মাধ্যমে স্থানীয় বাজারে চাহিদা মেটাতো। ধীরে ধীরে গুণগতমান এবং গ্রাহক সেবার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
২০১২ সালে মো. হাবিবুর রহমান সরকারের পুত্র, শরিফুজ্জামান সরকার প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি আধুনিক ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন এবং ডিজিটাল মার্কেটিং’র দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
বর্তমানে ব্রাদার্স ফার্নিচার বিভিন্ন ধরণের উপকরণ ব্যবহার করে আসবাব তৈরি করে থাকে। যেমন- কাঠ, স্টিল, পারটেক্স/বি-নাইল বোর্ড, অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক, মার্বেল, বাঁশ এবং বেত। এই বৈচিত্র্যময় কাঁচামালের ব্যবহার তাদের পণ্যে নান্দনিকতা, টেকসইতা এবং রুচিশীলতা নিশ্চিত করে।
ব্রাদার্স ফার্নিচার আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরও দক্ষ করেছে। সিএনসি কাটার, ল্যামিনেশন প্রেস, হাই-কোয়ালিটি স্প্রে ফিনিশারসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক মানের ফার্নিচার উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে।
২০১৮ সালে, প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব ই-কমার্স অ্যাপ চালু করে, যা ছিল দেশের আসবাব খাতে একটি উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন। এই অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকরা ঘরে বসে পণ্য ব্রাউজ, কনফিগার এবং অর্ডার করতে পারেন।
পেমেন্ট ব্যবস্থায় বিকাশের সঙ্গে একটি কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে প্রতিষ্ঠানটি। যার ফলে ডিজিটাল লেনদেন আরও সহজ হয়েছে।
২০২১ সাল থেকে ব্রাদার্স ফার্নিচার ঢাকা লেডিজ ক্লাবের সঙ্গে যৌথভাবে বিভিন্ন দাতব্য ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে। এর মাধ্যমে শুধু ব্যবসায়িক সফলতায় নয়, সামাজিক কল্যাণেও নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশের আসবাব রপ্তানি খাত সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে কিছু প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। ২০২১-২২ অর্থবছরে, হাতিল, আখতার, নাভানা, পারটেক্স, রিগ্যাল, নাদিয়া এবং ব্রাদার্স ফার্নিচার-এই প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ১৯০.৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আসবাব রপ্তানি করেছে। এই রপ্তানি আয় দেশের শিল্পখাতে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
ব্রাদার্স ফার্নিচারও অনেক দূর এগিয়ে গেছে, তবে এখনো বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। যেমন- কাঁচামালের দামের অস্থিরতা, দক্ষ জনবলের ঘাটতি এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা।
তবে আগামী দিনে প্রতিষ্ঠানটি ভার্চুয়াল রুম প্ল্যানার, কাস্টমাইজড ফার্নিচার কনফিগারেশন টুল এবং ইন্টেরিয়র ডিজাইন কনসালটিং সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা করছে।
ব্রাদার্স ফার্নিচার শুধু একটি আসবাব প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নয় বরং এটি বাংলাদেশের আসবাব শিল্পে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও রুচির মেলবন্ধনের একটি প্রতিচ্ছবি। উদ্যোক্তার প্রজ্ঞা, নেতৃত্বের স্থিতি এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি আজ দেশের আসবাব শিল্পে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে উঠেছে। পরিকল্পিত বিনিয়োগ, ডিজিটাল সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক রপ্তানির মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটি আরও বড় পরিসরে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারবে, এমনটাই প্রত্যাশা।