চার মাস পর দেশে ফিরে লাখো নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। দীর্ঘ চিকিৎসা-যাত্রা শেষে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে গুলশানের বাসা ফিরোজায় প্রবেশ করেন দুই পুত্রবধূকে সাথে নিয়ে। দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে অনেক দিনের গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে ফিরলেন নিজ গৃহে।
এর মাধ্যমে বিএনপি নেত্রীর রাজকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটে। খালেদা জিয়া আর দেশে ফিরবেন না বলে একটি গুঞ্জন ছড়িয়েছিল জোরেশোরেই। ‘মাইনাস টু’র কথাও ছড়িয়েছিল একটি মহল। সব গুজব, সন্দেহ আর অপেক্ষার অবসান হলো খালেদা জিয়ার ফেরার মধ্য দিয়ে।
বেগম জিয়ার ফিরে আসাকে গণতন্ত্র উত্তরণের পথকে সহজ করবে বলে জানান দলটির মহাসিচব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আর জাতির প্রয়োজনে খালেদা জিয়া শিগগিরই রাজনীতিতে নামবেন এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন তার সফরসঙ্গী চিকিৎসক ডাক্তার জাহিদ হোসেন। দলের প্রধানের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনে চাঙ্গা বিএনপির নেতাকর্মীরা। তবে মানুষের মনে প্রশ্ন খালেদা জিয়াকে কবে দেখা যাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
ঘড়ির কাঁটা দুপুর ১টা ২৫ মিনিট। খালেদা জিয়াকে বহনকারী নিশান পেট্রোল গাড়িটি প্রবেশ করে গুলশানের বাসা ফিরোজায়। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী বালির বাঁধের মতো ভেঙে যায় বিএনপি নেতাকর্মীদের চাপে। দলের প্রধানকে একনজর দেখতে ঢাকা এবং আশপাশের জেলার নেতারা ভিড় জমান গুলশানে ফিরোজার আশপাশে। এর আগে যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে রাজকীয় মর্যাদায় চিকিৎসা শেষে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দেশে ফেরেন। সঙ্গে ছিলেন দুই পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান ও ছোট পুত্রবধূ সৈয়দা শার্মিলা রহমান এবং ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্যানেল। পরে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া পাহারায় গুলশানের বাসায় যান বিএনপি নেত্রী ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এ সময় রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা লাখো লাখো নেতা-কর্মী এবং জনতা বিএনপি নেত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছার মাধ্যমে রাজসিক অভ্যর্থনা ও স্বাগত জানান।
উন্নত চিকিৎসা শেষে চার মাস পর দেশে ফিরে হেঁটে ফিরোজায় প্রবেশ করেন খালেদা জিয়া। তাকে হেঁটে ঘরে প্রবেশ করতে সহযোগিতা করেন পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান। তার বড় বোন শাহীনা জামান বিন্দু এবং গৃহকর্মী ফাতেমা। গাড়ি থেকে নেমে সহকারীদের সহায়তায় হেঁটে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় প্রবেশ করেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
দীর্ঘদিন ধরে নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগতে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জনসমক্ষে সাধারণত হুইলচেয়ারে দেখা গেলেও গতকাল ছিল এক ভিন্ন চিত্র। দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে গুলশানের ফিরোজায় গেলে গাড়ি থেকে নেমে সহযাত্রীদের সহায়তায় হেঁটে বাসায় প্রবেশ করেন তিনি। এই মুহূর্তটি বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে আবেগের সৃষ্টি করে। অনেকেই বলছেন, খালেদা জিয়ার এই নিজে হেঁটে বাসায় প্রবেশ শুধু তার শারীরিক উন্নতির প্রতীক নয়, বরং একটি আত্মবিশ্বাসী প্রত্যাবর্তনের বার্তাও হতে পারে। বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, ‘ম্যাডাম আজ নিজে হেঁটে ফিরোজায় ঢুকেছেন এটাই আমাদের কাছে অনেক বড় প্রেরণা। তিনি লড়াকু ছিলেন, আছেন, থাকবেন।’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে এদিন তার বড় পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান, ছোট পুত্রবধূ সৈয়দা শার্মিলা রহমান এবং চিকিৎসকসহ একটি প্রতিনিধিদল ছিল। এই প্রত্যাবর্তনের প্রতিটি মুহূর্ত দলীয় নেতাকর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন: ‘নেত্রী ফিরেছেন, নেত্রী হেঁটে এসেছেন’ এই বার্তায়। অসুস্থ খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসা শেষে নির্বাসিত পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান ও সৈয়দা শার্মিলা রহমানকে সাথে নিয়ে প্রবেশ করেন শান্তির নিবাসে।
দীর্ঘ যাত্রায় খালেদা জিয়া খানিক অসুস্থ হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের নেতা-কর্মীদের বাড়ির সামনে হট্টগোল না করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দীর্ঘ যাত্রা শেষে খানিকটা অসুস্থ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এখন তিনি বিশ্রামে আছেন। নেতা-কর্মীদের স্লোগান দিতে বারণ করেছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তিনি (খালেদা জিয়া) এখন একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চিকিৎসকরা তাকে পরামর্শ দিয়েছেন এবসুলেট রেস্ট নিতে। তাকে ঘুমিয়ে যেতে। আপনারা (নেতা-কর্মীরা) দয়া করে বাসার সামনে থেকে নিজ নিজ বাড়ি চলে যান। তাকে একটু বিশ্রাম নিতে দিন। এখানে কেউ গোলোযোগ সৃষ্টি করবেন না। নেতা-কর্মীদের স্লোগান না দিতে অনুরোধ করে মির্জা ফখরুল বলেন, দলের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, সবাই যার যার বাড়ি চলে যান। তাকে এখন এবসুলেট রেস্ট নিতে হবে কমপক্ষে। এখানে কেউ স্লোগান দেবেন না, কেউ ভিড় করবেন না।
খালেদা জিয়া আগের চেয়ে বেশ সুস্থ হয়ে ফিরেছেন বলে জানান তার চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। ফিরোজায় পৌঁছার পর বিএনপি নেতা ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন কাতার সরকারের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি জানান, কাতার সরকার শুধু এয়ার অ্যাম্বুলেন্সই প্রদান করেনি, বরং বিমানের খরচ, ওষুধ এবং চিকিৎসাসেবার সব কিছু নিশ্চিত করেছে। এই সহায়তার জন্য খালেদা জিয়া কাতার সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘কাতার সরকার খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য সব কিছু নিশ্চিত করেছে এবং এই মানবিক সহায়তা দেশনেত্রীর সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’
তারেক রহমান দেশে ফিরবেন কবে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা আশা করছি খুব শিগগিরই এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে, যাতে করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দেশে ফিরে জাতির নেতৃত্বে যোগ দিতে পারেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজ যিনি বেগম জিয়াকে তাচ্ছিল্য করেছিলেন, তিনিই আজ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পক্ষান্তরে বেগম জিয়া আজও এখানেই আছেন, জাতির নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত।’
জোবাইদা রহমান কত দিন দেশে আছেন এবং রাজনীতিতে তার প্রভাব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘১৭ বছর পর তিনি এসেছেন। এটা কেবল শুরু না। তারা তাদের দেশে আসবেন এটাই নরমাল। তার স্বামী-সন্তান এখনো বিদেশে। তিনি এখন দেশনেত্রীর সঙ্গে এসেছেন। আবার ফেরত যাবেন। সেখানে সব গুছিয়ে আবার সময়মতো চলে আসবেন।’
বিএনপির পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ এবং অন্য সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে, যারা খালেদা জিয়ার দেশে প্রত্যাবর্তনে সহায়তা করেছে। ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যেসব সংস্থা মানবিক অবস্থান থেকে সহযোগিতা করেছে, তাদের প্রতি আমাদের ধন্যবাদ।’
এর আগে খালেদা জিয়া রাজকীয় মর্যাদায় চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরেন কাতারের আমিরের দেওয়া একটি বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দেশের মাটিতে নামেন বেগম জিয়া। বিএনপি মহাসচিবসহ দলের সিনিয়র নেতারা তাকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধের প্রতীক। তার ফেরায় গণতন্ত্রের উত্তরণ সহজ হবে বলেও মনে করেন তিনি।
বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে লাখো নেতা-কর্মী জড়ো হন তাকে শুভেচ্ছা জানাতে। কারো হাতে ছিল ফুল, কেউ আবার এনেছিলেন নেত্রীর ছবি। আর দলীয় ও জাতীয় পতাকা ছিল হাতে হাতে। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী পাশ কাটিয়ে দলীয় চেয়ারপাসেনকে স্বাগত জানান নেতা-কর্মীরা। ১০ কিলোমিটারের এই পথে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের নামে ব্যানার হাতে নেতা-কর্মীদের স্লোগান দিতে দেখা যায়। দীর্ঘ ১৭ বছর নির্বাসনে থাকার পর শাশুড়ির সাথে দেশে ফিরলেন জোবাইদা।
খালেদা জিয়া সর্বশেষ জনসভায় অংশগ্রহণ করেন ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর, আর কারাগারে যেতে হবে আন্দাজ করে ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অংশ নেন দলের বর্ধিত সভায়। ২ বছরের কারাভোগ আর রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকাসহ ২৫ শর্তে সাজা স্থগিত করা হলেও যেখানে চিকিৎসাই করাতে পারছিলেন না সেখানে তো রাজনীতি বহুদূর।
ফ্যাসিবাদের পতনের পর লন্ডনে ৪ মাসের চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। শারীরিক ও মানসিকভাবে খালেদা জিয়া অনেকটা সুস্থ বলেই জানালেন তার চিকিৎসক ডা. জাহিদ। দেশ ও মানুষের প্রয়োজনে দ্রুত সময়ে রাজনীতির মাঠেও দেখা যাবে বলে আশা তার।