২০২৩ সালের মার্চে তড়িঘড়ি করে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির জন্ম দেয় বেক্সিমকো গ্রুপ। যার নাম দেওয়া হয় শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেড (এসটিএল)। লক্ষ্য ছিল গাজীপুরে মায়ানগর নামক একটি বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন। এটি প্রতিষ্ঠার পরপরই ‘আইএফআইসি আমার বন্ড’ নামে একটি আর্থিক প্যাকেজ বাজারে আসে যার মাধ্যমে ১,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য ধরা হয়। ১২ শতাংশ মুনাফার প্রতিশ্রুতিতে মাত্র পাঁচ সপ্তাহে ১,০০০ কোটি টাকার বন্ড বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ২০০ কোটি টাকার এফডিআর করা হলেও বাকি ৮০০ কোটি টাকা বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিংসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে স্থানান্তর ও আত্মসাৎ করা হয়। আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে গত মাসে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে বড় ধরণের চাপে পড়েছে ‘আইএফআইসি আমার বন্ড’র একমাত্র গ্যারান্টার খোদ ব্যাংকটি নিজেই।
জানা যায়, রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বাজার থেকে প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে।
জানা গেছে, ব্যাংকসহ একাধিক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীকে বন্ডে বিনিয়োগ করতে চাপ দেওয়া হয়েছিল। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শ্রীপুর টাউনশিপের ১,০০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর অনুমোদন দেয়, যেখানে আইএফআইসি ব্যাংক গ্যারান্টর হিসেবে কাজ করে। ‘আইএফআইসি আমার বন্ড’ নামে বাজারজাত করা এ বন্ড এক মাসের মধ্যে ৭,১৭৩ জন বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করে।
বন্ডের শর্ত অনুযায়ী, নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের পাশে গাজীপুরের ৭৬ লাখ বর্গফুট জমিতে গড়ে ওঠার কথা ছিল মায়ানগর প্রকল্পের। পুরো প্রকল্পের প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ৬,০৯৫ কোটি টাকা। জমির মালিকানার ৭৫ শতাংশ ছিল বেক্সিমকোর এবং ২৫ শতাংশ এসটিএলের। অর্থায়ন হওয়ার কথা ছিল ইক্যুইটি, ঋণ, জমির মালিকদের অবদান এবং ক্রেতাদের অগ্রিমের মাধ্যমে। ২০২৩ সালে ইস্যু করা বন্ডের মাধ্যমে ১,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয় এবং মেয়াদ শেষে ১,৬০০ কোটি টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের মে মাসে ঋণ পুনঃঅর্থায়ন ও এসটিএলে তহবিল আনার নামে বেক্সিমকো বিএসইসির কাছ থেকে নতুন বন্ড ইস্যুর অনুমোদন পায়। তবে এরপর রাজনৈতিক পরিবেশ বদলে যায়। এবার ১৫ শতাংশ রিটার্নের প্রস্তাব দেওয়া হয়। আলোচিত এ বন্ড বাজারে আনার সময় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান রহমান এবং তার ছেলে শায়ান যথাক্রমে আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর সালমান গ্রেপ্তার হন।
জানতে চাইলে এসটিএলের কোম্পানি সচিব কায়সার আহমেদ জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বিক্ষোভকারীরা নির্মাণ সামগ্রী ভাঙচুর করে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ক্ষতি করে এবং সীমানা প্রাচীরও ধ্বংস করে। ভূমি উন্নয়ন ও রাস্তা নির্মাণ শেষ হলেও ভবন নির্মাণ শুরু হয়নি। আইএফআইসি ব্যাংকের মুখপাত্র রফিকুল ইসলাম বলেন, ২৪০ কোটি টাকার রিজার্ভ তহবিল শেষ হতে আরও ছয় মাস লাগবে।
তিনি বলেন, তহবিল শেষ হওয়ার আগে আমরা প্রকল্প মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করব। তাদের পরিকল্পনা শুনে তা বোর্ডে উপস্থাপন করা হবে। যেহেতু আমরা বন্ডের গ্যারান্টার, তাই বোর্ডের নির্দেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এদিকে ‘প্রতারণার’ মাধ্যমে আইএফআইসি আমার বন্ড এর ১০০০ কোটি টাকা তুলে তা ‘আত্মসাতের’ অভিযোগে গত মাসে আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, তার ছেলে শায়ান ফজলুর রহমান এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জনসাধারণের কাছ থেকে বন্ড ছেড়ে তোলা এই অর্থ ‘সন্দেহজনক বিভিন্ন লেনদেনের মাধ্যমে উত্তোলন করে আত্মসাৎ’ করার অভিযোগের এ মামলায় তাদের সঙ্গে আসামি করা হয়েছে মোট ৩০ জনকে; যাদের বেশির ভাগ আইএফআইস ব্যাংকের কর্মকর্তা।
এজাহারে অভিযোগ করা হয়, আইএফআইসি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় বন্ধক রাখা সম্পত্তি ‘অস্বাভাবিকভাবে অতিমূল্যায়ন’ দেখিয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে বন্ড বিক্রির মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। এই অর্থ শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের (এসটিএল) চলতি হিসাবে জমা হওয়ার পর সেখান থেকে ২০০ কোটি টাকা ‘রিডেম্পশন অ্যাকাউন্টে’ এফডিআর (মেয়াদি আমানত) করা হয়। বাকি ৮০০ কোটি টাকা, যা সরকারি অর্থ হিসেবে বিবেচিত, তা বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডসহ বেক্সিমকো গ্রুপ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন হিসেবে স্থানান্তর করা হয়। এরপর ‘ব্যাংকিং নিয়মনীতি উপেক্ষা’ করে সেই অর্থ ’নগদে এবং সন্দেহজনক বিভিন্ন লেনদেনের’ মাধ্যমে উত্তোলন করে ‘আত্মসাৎ’ করা হয় বলে মামলায় ৩০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে দুদক।
এতে বলা হয়, ’আত্মসাৎ’ করা অর্থ একাধিক ধাপে স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে ‘লেয়ারিং’ (অর্থ গোপনের কৌশল) করে দোষীরা ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ করেছেন।
অপরদিকে ‘আইএফআইসি আমার বন্ড’ অনুমোদনের সময় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ছিলেন শিবলী রুবাইয়াত। মামলায় আরও আসামি করা হয়েছে শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মশিউজ্জামান ও পরিচালক তিলাত শাহরিন, আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহ আলম সারোয়ার ও সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক সুধাংশু শেখর বিশ্বাস, এআরএম নাজমুস সাকিব, কামরুন নাহার আহমেদ, রাবেয়া জামালী, গোলাম মোস্তফা ও মো. জাফর ইকবাল, বিএসইসির সাবেক কমিশনার রুমানা ইসলাম, মিজানুর রহমান, শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ও মো. আবদুল হালিমকে। অন্য আসামিরা হলেন- আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মনসুর মোস্তফা, হেড অব লোন পারফরমেন্স ম্যানেজমেন্ট শাহ মো. মঈনউদ্দিন, চিফ বিজনেস অফিসার (রিটেইল) মো. রফিকুল ইসলাম, চিফ বিজনেস অফিসার (করপোরেট) গীতাঙ্ক দেবদীপ দত্ত, চিফ অব আইটি মো. নুরুল হাসনাত, চিফ ইনফরমেশন অফিসার মনিতুর রহমান ও হেড অব ট্রেজারি মোহাম্মদ শাহিন উদ্দিন।
এছাড়া ব্যাংকটির ধানমন্ডি শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক ও এফভিপি নাজিমুল হক, সাবেক ব্যবস্থাপক হোসাইন শাহ আলী এবং রিলেশনশিপস ম্যানেজার সরদার মো. মমিনুল ইসলাম, সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিমাই কুমার সাহা, কোম্পানি সেক্রেটারি মো. মিজানুর রহমান, আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক ব্রাঞ্চ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কমপ্লায়েন্স অফিসার আয়েশা সিদ্দিকা ও সিলভিয়া চৌধুরীও মামলার আসামি হয়েছেন।
এজাহারে যেসব অভিযোগ
শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মশিউজ্জামান ও পরিচালক তিলাত শাহরিনের ব্যাংক হিসাবগুলোতে অস্বাভাবিক পরিমাণে লেনদেন দেখানোর উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালের ৭ মার্চ আইএফআইসি ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় তাদের নামে দুটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলা হয়। এই দুই হিসাবে মাত্র ছয় কর্মদিবসের (২৯ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল ২০২৩) মধ্যে প্রত্যেকটিতে ১৬৭ কোটি ৫০ লাখ ২ হাজার টাকা করে মোট ৩৩৫ কোটি টাকার মতো লেনদেন দেখানো হয়, যা ছিল সম্পূর্ণ কৃত্রিম এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে দেখানো। অথচ তাদের ব্যক্তিগত ব্যাংক লেনদেনের প্রোফাইলে মাসিক লেনদেনের সীমা এক লাখ টাকারও কম।
এ কৃত্রিম লেনদেন সম্ভব হয় মূলত ব্যাংকের পরিচালক এ. আর. এম. নাজমুস সাকিবের মালিকানাধীন ‘ট্রেড নেক্সট’ নামের কোম্পানির বড় অঙ্কের অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যমে। এসব লেনদেন সন্দেহজনক হওয়ার পরও ধানমন্ডি শাখার তৎকালীন ব্রাঞ্চ অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কমপ্লায়েন্স অফিসার (বিএএমএলসিও) সিলভিয়া চৌধুরী এবং শাখা ব্যবস্থাপক মো. নাজিমুল হক এ বিষয়ে কোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপের প্রতিবেদন (এসএআর) বা সন্দেহজনক লেনদেনের প্রতিবেদন (এসটিআর) দাখিল করেননি। বরং তারা মশিউজ্জামান ও তিলাত শাহরিনকে অপরাধ সংঘটনের সুযোগ দিয়ে দন্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধে যুক্ত হন।
এজাহারে বলা হয়, অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ১৪ মার্চ শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের নামে আইএফআইসি ব্যাংকে একটি চলতি হিসাব খোলা হয়। হিসাব খোলার ফরমে মশিউজ্জামানকে চেয়ারম্যান এবং তিলাত শাহরিনকে পরিচালক হিসেবে দেখানো হলেও কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন ফরম ১১২ অনুসারে মশিউজ্জামান ছিলেন ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল এই প্রতিষ্ঠান থেকে আইএফআইসি ব্যাংকে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের জন্য গ্যারান্টির আবেদন করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখা ৩ মে প্রধান কার্যালয়ে একটি ক্রেডিট প্রস্তাবনা পাঠায়। সেখানে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি একটি নতুন গ্রাহক এবং তাদের সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্ট নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান বা পরিচালকদের আর্থিক ইতিহাস যাচাই করা হয়নি এবং তাদের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে এমন কোনো প্রমাণও ছিল না।
অনুসন্ধানের তথ্য তুলে ধরে এজাহারে অভিযোগ করা হয়, আইএফআইসি ব্যাংকের কাছে শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের জামানত হিসেবে বন্ধক রাখা মোট ৩ হাজার ৭১৬ দশমিক ৫ শতাংশ জমির প্রকৃত মূল্য ছিল প্রায় ৮৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা (সরকারি মৌজা রেট অনুযায়ী)। কিন্তু এই জমির মূল্য অতিমূল্যায়ন করে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা দেখানো হয় এবং এই অতিমূল্যায়িত সম্পত্তিকে ভিত্তি করেই শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের পক্ষে এক হাজার কোটি টাকার বন্ডের জন্য আইএফআইসি ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদান করে। ব্যাংকের শাখা, প্রধান কার্যালয় বা পরিচালনা পর্ষদ কোনো পর্যায়েই এই অতিমূল্যায়ন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি বা যাচাই করা হয়নি।