ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই, ২০২৫

‘মা, তোমার আর খালে গিয়ে পানি আনতে হবে না’

মো. মামুন হোসেন, পিরোজপুর
প্রকাশিত: জুলাই ১, ২০২৫, ০৬:৪৪ পিএম
শহিদ এমদাদুল হক।

ঢাকা, ২০ জুলাই ২০২৪, উত্তপ্ত রাজপথে ইতিহাস রচনার প্রাক্কালে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে রক্ত ঝরান পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার সাহসী সন্তান এমদাদুল হক। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান এই তরুণ, যিনি ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন এবং পেশায় গাড়ি চালক হলেও অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাজপথে দাঁড়াতে কখনও পিছপা হননি।

সকাল ৯টার দিকে উত্তর বাড্ডার এ.এম. জেড হাসপাতালের পাশে এক হোটেলে সহযোদ্ধা সজীবের সঙ্গে নাশতা সেরে আন্দোলনে অংশ নেন এমদাদুল। এরপর হঠাৎ করেই ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পুলিশের একটি সাঁজোয়া বহর আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়। শুরু হয় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ। এক পর্যায়ে কাছ থেকে ছোঁড়া পুলিশের গুলি তার কপাল ভেদ করে মাথা চিরে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই নিথর হয়ে পড়েন এই লড়াকু তরুণ।

সহযোদ্ধারা হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলেও পথেই থেমে যায় তার জীবন। এক নিপীড়নবিরোধী শহীদ হয়ে তিনি নাম লেখান ‘জুলাই বিপ্লব’-এর বেদীমূলে।

ভান্ডারিয়া উপজেলার ধাওয়া গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম এমদাদুল হকের। পিতা মো. ছোবাহান হাওলাদার ও মা ফাতিমা বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ। অভাব-অনটনের কারণে লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি, কিন্তু মায়ের কষ্ট লাঘবে এবং সংসারের চাকা সচল রাখতে গাড়ি চালানোকে পেশা হিসেবে বেছে নেন।

কান্নাভেজা কণ্ঠে মা ফাতিমা বলেন, ‘আমার ছেলেটা যদি একটু ফিরে আসত! ও তো বলেছিল, ‘মা, তোমার আর খালে গিয়ে পানি আনতে হবে না। আমি মোটর কিনে দেব। কিন্তু পানির মোটরের বদলে পেলাম ছেলের লাশ।’

অপরদিকে বৃদ্ধ পিতা ছোবাহান হাওলাদার নির্বাক- চোখে জল আর দীর্ঘশ্বাসে বুকে জমে থাকা ব্যথার বিস্ফোরণ।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, জমিজমা কিংবা কোনো স্থায়ী উপার্জনের উৎস নেই এই পরিবারে। এমদাদুলই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যু যেন পুরো পরিবারটির একমাত্র খুঁটি উপড়ে নেওয়ার মতোই। সরকারি-বেসরকারি কিছু সহায়তা ও ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এর কিছু সহায়তায় কোনোমতে টিকে আছেন তারা। সর্বশেষ ঈদুল আযহায় পেয়েছেন কিছু ঈদসামগ্রী।

গ্রামে মরদেহ পৌঁছালে স্থানীয় একদল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ প্রকাশ্যে জানাজা বন্ধের চেষ্টা চালায়। তবে এলাকাবাসীর প্রতিবাদে তারা পিছু হটলেও দাফনে অংশগ্রহণকারী অনেকেই পরে নানা হুমকির শিকার হন।

২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এমদাদুলের আত্মীয় সাইফুল ইসলাম বাড্ডা থানায় ১২১ জন নামীয় এবং আরও প্রায় ২০০ অজ্ঞাত আসামির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা (নং-১১) দায়ের করেন। তবে এখনও পর্যন্ত মামলায় উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। 

ভান্ডারিয়া থানার ওসি আহমদ আনোয়ার বলেন, ‘মামলাটি ঢাকার বাড্ডা থানায় হওয়ায় তদন্তের দায় তাদের। তারা যদি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠায়, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

‘জুলাই বিপ্লব’-এর প্রতিটি রক্তবিন্দুই যেন শোষণ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একেকটি উচ্চারণ, একেকটি শপথ। এমদাদুল হক সেই শপথের একজন শহীদ সৈনিক। তার গল্প কেবল একজন সন্তানের নয়, এটি একজন কর্মীর, একজন লড়াকুর, একজন ইতিহাস নির্মাতার অমর স্মৃতি।