ঢাকা শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

চামড়ায় সেই পুরোনো চক্র এবারও ন্যায্য দাম মিলেনি

রহিম শেখ
প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০২৫, ০৪:৫৯ এএম
ছবি- সংগৃহীত

বছরপাঁচেক আগেও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাড়া-মহল্লায় ও বাড়িতে গিয়ে দরদাম করে চামড়া কিনতেন। কয়েক বছর টানা দাম না পাওয়ায় পাল্টে গেছে সেই চিত্র। সরকার প্রতিবছর লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু লবণ ছাড়া অর্থাৎ রক্ত-মাংসযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে না। ফলে প্রাথমিক ধাপের এ চামড়ার ন্যায্য দর পাওয়া যায়নি এবারও।

সাধারণ মানুষ ক্রেতা না পেয়ে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানায় বিনা মূল্যে চামড়া দান করে দেয়। এবারও দেখা গেছে সেই চিত্র। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এবার ১৩ লাখের বেশি চামড়া সংরক্ষণ করতে পেরেছে এতিমখানা ও লিল্লাহ বোডিংগুলো। স্থানীয় আড়তদারের কাছে মাঝারি সাইজের চামড়া ৪০০ টাকা আর বড় চামড়া ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছে এসব প্রতিষ্ঠান।

আড়তদাররা লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে এ চামড়া বিক্রি করবেন বড় ব্যবসায়ী বা ট্যানারি মালিকদের কাছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, পবিত্র ঈদুল আজহায় এ বছর দেশে গরু ও মহিষ ৪৭ লাখ পাঁচ হাজার ১০৬টি কোরবানি হয়েছে। সে হিসাবে ৩৪ লাখ পাঁচ হাজার ১০৬টি পশুর চামড়ার ভাগ্যে কী ঘটেছে তা অজানা।

তবে এবারও পানির দামে চামড়া কিনেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবার সিন্ডিকেট এতটাই সক্রিয় ছিল যে, চট্টগ্রামে ১০ টনের মতো চামড়া ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে সিটি করপোরেশন জানিয়েছে। কিন্তু এই সংকট উত্তোরণে বিশেষজ্ঞরা চামড়ার দাম বেঁধে দেওয়ার বিপক্ষে।

তাদের মতে, উপযুক্ত দাম নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ অর্জন করার বিকল্প নেই। দাম নির্ধারণ না করে কোরবানির চামড়াকে ছেড়ে দিতে হবে মুক্ত বাজারের ওপর। তাহলে লবণ দেওয়ার আগে কিংবা পরে সব স্তরেই চামড়ার ন্যায্য দাম নিশ্চিত হবে।

জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গতবারের চেয়ে ৫ টাকা বাড়িয়ে ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, ঢাকার বাইরে নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। এতে ঢাকায় লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার সর্বনিম্ন দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। খাসির লবণযুক্ত চামড়া প্রতি বর্গফুট ২২ থেকে ২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। রাজধানীতে চামড়ার দাম প্রতি ফুটে ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

তবে তার প্রভাব পড়েনি বাস্তবে। গত বছরের মতো এবারও কম দামে সব ধরনের চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতি বর্গফুট গরুর চমড়ার দাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৬০ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও চামড়া বিক্রি হয়েছে গতবারের মতোই ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্গফুটের হিসাবে চামড়ার দাম আরও কম পড়েছে।

তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, বিগত ১০ বছরের মধ্যে দেশে এবার সর্বোচ্চ দরে চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে। চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, কোরবানিদাতাদের থেকে তারা সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ৭৫০ টাকায় গরুর চামড়া কিনেছেন এবং ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করেছেন ৬০০ থেকে ৯০০ টাকায়। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করে চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়া যায়নি।

যদিও বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ঈদুল আজহার দিন গণমাধ্যমে বলেছেন, বিগত ১২ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে। সরকার চামড়ার পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে চামড়া সংরক্ষণ না করে পচিয়ে ফেললে সে দায়িত্ব সরকারের না। 

মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মতে, সরকার প্রতি বছর লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু লবণ ছাড়া অর্থাৎ রক্ত-মাংসযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে না। ফলে প্রাথমিক ধাপের এ চামড়ার ন্যায্য দর পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে দিন দিন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা হারিয়ে যাচ্ছেন।

সাধারণ মানুষ ক্রেতা না পেয়ে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানায় বিনামূল্যে চামড়া দান করে দেন। অনেক এলাকায় এখন মাদ্রাসা ও এতিমখানাকে ফোন করে ডেকে এনে চামড়া দিতে হয়। এসব প্রতিষ্ঠানকে কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করেন স্থানীয় আড়তদাররা।

উত্তরার চামড়া ব্যবসায়ী হেফাজ উল্লাহ বলেন, কোরবানিদাতাদের থেকে ৭৫০ টাকায় চামড়া সংগ্রহ করে রীতিমতো বিপদে পড়তে হয়েছে। এই এলাকায় ভালো মানের চামড়ার দাম উঠেছে সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে ৮২০ টাকা। এর ওপরে কোনোভাবেই চামড়া বিক্রি করা যায়নি।

বাড্ডার চামড়া ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বলেন, কাঁচা চামড়ার চাহিদা এবারও তলানিতে। ভালো দামে চামড়া বিক্রি করতে পারিনি। একটি ভ্যান আর দুইজন লেবার নিয়ে যে খরচ হয়েছে তার তুলনায় মুনাফা হয়নি বললেই চলে। সারাদিনের কষ্ট বৃথা।

তবে এ ব্যাপারে ট্যানারি পরিচালক ও এজেন্টরা জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় লবণ দেওয়া প্রস্তুতকৃত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে ট্যানারি থেকে কাঁচা চামড়া কেনায় দাম কম পড়েছে। তবে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায় সব চামড়া কেনা হয়েছে। এমন তথ্য ভুল দাবি করেছেন তারা। অনেক ভালো মানের চামড়া এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায়ও কেনা হয়েছে বলে জানান ট্যানারি সংশ্লিষ্টরা।

গতবারের মতো এবারও ছাগলের চামড়ার চাহিদা নেই বললেই চলে। অনেকেই বিনামূল্যে ছাগলের চামড়া দিয়ে দিয়েছেন, অনেকক্ষেত্রে দাম উঠেছে ১৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। এবারের ঈদে সব মিলিয়ে ৮০ থেকে ৮৫ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ট্যানারি মালিকরা, যার সিংহভাগ সংগ্রহ হয়েছে ঈদের প্রথম দিনেই।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পবিত্র ঈদুল আজহায় এ বছর দেশে ৯১ লাখের বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। এর মধ্যে গরু ও মহিষ ৪৭ লাখ পাঁচ হাজার ১০৬টি, ছাগল ও ভেড়া ৪৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৬৮টি এবং অন্যান্য প্রাণি ৯৬০টি। কিন্তু চামড়ার ক্রয়ক্ষমতা, সংরক্ষণের খরচ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যয় বিবেচনায় অনেক আড়তদার ও ট্যানারি প্রতিষ্ঠান নিরাপদ দামে চামড়া কিনতেই আগ্রহী হচ্ছেন না।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এ বছর ৯৩৩০টি এতিমখানা ও লিল্লাহ বোডিংগুলো ১৩ লাখের বেশি চামড়া সংরক্ষণ করতে পেরেছে। মন্ত্রণালয়ের দাবি, কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী কর্তৃক চামড়ার লবণ না দিয়ে আড়তদারদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে দরকষাকষি ও আড়তদার কর্তৃক চামড়া ক্রয় অনিহা দেখানোর কারণে চামড়া নষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, বিভিন্ন কারণে চামড়া নষ্ট হয়। সে জন্য দাম পাচ্ছে না অনেকে। তবে অন্য বছরের চেয়ে এবার দাম সন্তোষজনক। চামড়া কেনার ক্ষেত্রে ট্যানারি মালিকদের মধ্যে কোনো সিন্ডিকেট নেই বলে তিনি দাবি করেন।

মিজানুর রহমানের মতে, মাঝারি আকারের তথা ২০-২৫ বর্গফুটের একটি চামড়ায় ৫ থেকে ৬ কেজি মোটা দানার লবণ প্রয়োজন হয়। এ ধরনের লবণের কেজি ১০ থেকে ১৫ টাকা। আড়তদারদের হিসাবে, মাঝারি আকারের একটি চামড়ায় লবণ বাবদ খরচ হয় কমবেশি ৭০ টাকা। এর সঙ্গে শ্রমিক ও পরিবহন খরচ মিলিয়ে প্রতিটি চামড়ায় খরচ হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এ হিসাবে আড়তদারের প্রতিটি চামড়ায় খরচ হতে পারে ১ হাজার টাকার মতো। 

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, কোরবানির পর লবণ ছাড়া পশুর চামড়া ৮ থেকে ৯ ঘণ্টার বেশি রাখা যায় না। ফলে কোরবানির দিনই বিক্রি হয় লবণ ছাড়া চামড়া। এ পর্যায়ে দর নির্ধারিত থাকে না। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত ‘ক্রাস্ট’ ও ‘ফিনিশড লেদার’ অর্থাৎ সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানি হয়। ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি হয় না বলা চলে।

এবার ন্যায্য দর নিশ্চিত করতে সরকার কাঁচা চামড়া এবং ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি তিন মাসের জন্য শিথিল করেছে। চামড়া থেকে পশম ছাড়িয়ে প্রক্রিয়াজাত করার পর যেটি পাওয়া যায়, তাকেই ওয়েট ব্লু চামড়া বলা হয়। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা। ইলিয়াস হোসেন বলেন, এই সুযোগটি অব্যাহত রাখা দরকার। এ জন্য সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। তাহলে ভবিষ্যতে চামড়ার চাহিদা বাড়বে, ভালো দামও পাওয়া যাবে।

চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী অন্যতম প্রতিষ্ঠান এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিম মঞ্জুর বলেন, কোরবানির পশুর চামড়া প্রতি জেলায় জেলায় সংরক্ষণের জন্য আধুনিক ব্যবস্থা থাকতে হবে। সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে চামড়া বেচাকেনায় কোনো ধরনের অনিয়ম হবে না। এ ব্যবস্থা বেসরকারি উদ্যোগেও হতে পারে।

আবার সরকারি উদ্যোগেও হতে পারে। চামড়া খাতের শীর্ষ এই ব্যবসায়ী বলেন, ব্যবসায়ীরা নিয়ম-কানুন মেনে ব্যবসা করতে চান। সব ব্যবসায় কিছু ব্যক্তি সিন্ডিকেট করেন। এ জন্য তো সব ব্যবসায়ীরা দায়ী নন। সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।     

এলডব্লিউজি সনদ দরকার: বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র ৮টি প্রতিষ্ঠানের এলডব্লিউজি সনদ রয়েছে। বাংলাদেশ মূলত এমন সব বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে যেখানে ব্র্যান্ড মূল্য নেই। 

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বলেন, চামড়ার তরল ও কঠিন বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে এলডব্লিউজি সনদের জন্য অডিটরকে ডাকতে পারি। কিন্তু হচ্ছে না। চামড়া খাতের উন্নয়নে বিশেষ কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হলেও, তা বাস্তবতার মুখ দেখেনি। 

সক্ষমতার বেশি বর্জ্য: বর্তমানে সাভারে সিইটিপি প্রায় ১৮ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য শোধনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে ঈদুল আজহার সময়ে অন্তত ৪৫ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য শোধনের প্রয়োজন পড়ে। ফলে অপরিশোধিত বর্জ্যরে বড় অংশই পড়ছে ধলেশ্বরী নদীতে। এসব কারণে মিলছে না চামড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে এলডব্লিউজি সনদ। দাম পাচ্ছেন না মৌসুমি ব্যবসায়ীও।