রাজধানীজুড়ে ফুটপাত ও সড়ক দখল করে চলছে হরেক রকমের ব্যবসা। আসন্ন ঈদ সামনে রেখে বর্তমানে এই ব্যবসা জমজমাট। এতে করে যানজটের পাশাপাশি জনভোগান্তির শিকার হচ্ছে নগরবাসী।
অস্থায়ী এসব দোকান থেকেই আসে কোটি-কোটি টাকা, লাইনম্যান, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা, স্থানীয় চাঁদাবাজ এমনকি পুলিশের পকেটেও নিয়মিত ভাগ হয়ে যায় এই টাকা। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে প্রায়শই সিটি করপোরেশন ও পুলিশের উচ্ছেদ অভিযান চালাতে দেখা গেলেও ফলাফল মিলছে না, বরং উচ্ছেদ অভিযানে গিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। এর কারণ একই ফুটপাতে হ্ছে টাকা বানানোর মেশিন
এদিকে, ডিএনসিসি থেকে দুই দিন আগে জানানো হয়েছে, যেসব দোকানদার ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করবে, তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল ও দোকান সিলগালা করা হবে। এতশত অভিযানেও থামছে না ফুটপাত দখল ও ব্যবসা।
সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয় যে ঘটনায়, গত বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার ফুটপাতে অবৈধ উচ্ছেদ অভিযান চালান মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত। সে সময় ফুটপাতের একটি ফুডকোর্টের ব্যবসা করা মহিউদ্দিনের নামে এক তরুণ উচ্ছেদ অভিযান বন্ধে প্রতিবাদ জানান।
তিনি দাবি করেন, বাজারে সবকিছুর দাম যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন পরিবারকে সহযোগিতা করতেই তিনি এই দোকান পরিচালনা করছেন। তিনি তো চুরি-ডাকাতি করছেন না। কাউকে অসুবিধা না করে এমন সৎ কাজও কেন তিনি এই বাংলাদেশে করতে পারবেন না? এসময় ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনি আমার দোকান ভাঙলেন কেন? তাহলে আমাকে চাকরি দেন, আমার আয়ের উৎসের জোগান দেন। এরপর পুলিশ তাকে আটক করে মারধর করতে করতে পুলিশ ভ্যানে ওঠায়।
মহিউদ্দিনের এই বক্তব্য এবং পুলিশের মারধরের ভিডিও মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর থেকে প্রশ্ন উঠতে থাকে দেশের বেকারত্ব বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের অভাব এবং পুলিশের মারমুখী আচরণ নিয়ে।
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। পরবর্তী সময়ে আটক মহিউদ্দিনকে ছাড়াতে সরকারের দুজন উপদেষ্টার তৎপরতায় সেদিন রাতেই পুলিশ মুচলেকা নিয়ে তার বাবা-মায়ের জিম্মায় ছেড়ে দেয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী আহমেদ মাসুদ বলেন, ‘উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে মহিউদ্দিন নামে ওই তরুণের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে আটক করা হয়েছিল।
এদিকে পুলিশ বলছে, ফুটপাত ও সড়ক দখল করে জনসাধারণের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা আইনগত অপরাধ। এছাড়া অবৈধভাবে ফুটপাত দখল করে ভাসমান বা স্থায়ী দোকানপাট গড়ে ওঠায় যানজটের পাশাপাশি জনভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন সময়ে সিটি করপোরেশন ও পুলিশের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়।
তবে বাস্তবে দেখা গেছে, ঢাকার বেশির ভাগ প্রধান সড়কের পাশের ফুটপাত দখল করে ব্যবসা চালাচ্ছেন হকাররা। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের প্রশ্রয়ের অভিযোগ রয়েছে।
ঠিকমতো চলাচল করতে পারে না পথচারীরা: ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বুধবার পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানের পরও আগের মতোই ফুটপাত দখল করে রেখেছেন দোকানিরা। পুলিশের অভিযানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দখলদারি অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে জিগাতলা থেকে ধানমন্ডি শংকর পর্যন্ত রাস্তার দুপাশ ফুটপাত দখল করে বিভিন্ন দোকান গড়ে উঠেছে।
অভিযানের পর যেন দোকানের সংখ্যা আরও বেড়েছে। দোকানিরা জানান, সামনে ঈদ, ব্যবসা না করলে তারা চলবেন কী করে? ফুটপাতে দোকান করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই।
ফলে রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতেও তাদের ফুটপাতে দোকান করতে হয়। অন্যদিকে রাজধানীর গুলশান, বনানী থেকে শুরু করে উত্তরা, বাড্ডা, মহাখালী, ফার্মগেট, মিরপুর, গুলিস্তান, মৌচাক-মালিবাগ, যাত্রাবাড়ীসহ অনেক এলাকায় ঈদ ঘিরে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা চালাচ্ছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেছেন, যেসব দোকানদার ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করবেন, তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হবে। দোকান সিলগালা করা হবে। গত শনিবার মিরপুর ৬০ ফুট রাস্তার চলমান উন্নয়নকাজ পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ কথা বলেন।
ফুটপাতেই টাকা বানানোর মেশিন: ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতায় পুরো শহরে তিন লাখেরও বেশি অস্থায়ী দোকান রয়েছে। রাস্তার পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অস্থায়ী এসব দোকান থেকেই আসে কোটি কোটি টাকা।
লাইনম্যান, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা, স্থানীয় চাঁদাবাজ, এমনকি পুলিশের পকেটেও নিয়মিত ভাগ হয়ে যায় এই টাকার বড় একটি অংশ। ফুটপাতের পাশে এসব দোকান চালিয়ে হকারদের জীবন না চললেও অনায়েসেই অবৈধ এসব টাকায় সংসার চালাচ্ছেন এই চক্রের সদস্যরা, গড়ে তুলছেন টাকার পাহাড়। ঢাকার এই ফুটপাতই যেন টাকার মেশিন- এমনটাই বলছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
অনুসন্ধান বলছে, দোকান বসানোর অনুমতি নিতে লাইনম্যান নামে পরিচিত স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দ্বারা গঠিত চক্রের কাছে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয় হকারদের। দোকানের আকার ও অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে হকারদের দৈনিক ৫০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা গুনতে হয়। দিন শেষে ফেরিওয়ালাদের থেকে তোলা চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩ কোটি টাকার বেশি।
আর নতুন দোকান বসাতে দিতে হয় ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। হিসাব অনুযায়ী মাসে প্রায় ৪০ কোটি এবং বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজদের পকেটে যাচ্ছে। বিআইজিডির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার ফুটপাতে বছরে প্রায় ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়, যা দুই সিটি করপোরেশনের সম্মিলিত বাজেটের প্রায় সমান।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, পল্টন, মতিঝিল, দৈনিক বাংলা মোড়, গোলাপশাহ মাজার, নিউমার্কেট, জিরো পয়েন্ট, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও ফুলবাড়িয়ায় সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দোকান রয়েছে।
হকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গুলিস্তান ও এর আশপাশের এলাকায় ভ্রাম্যমাণ ও ফুটপাতে বসা হকারদের দিনে ন্যূনতম ৫০ থেকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। এই ফুটপাত দখল করে অবৈধ পথে হকারদের ব্যবসা চলে। ঢাকার রাস্তায় আড়াই লাখের বেশি হকার ব্যবসা করেন।
ফুটপাতে বসতে একজন হকারকে এলাকাভেদে ৫০ থেকে ৫০০ টাকা লাইনম্যানদের দিতে হয়। লাইনম্যানদের মাধ্যমে এই টাকার ভাগ চলে যায় রাজনৈতিক নেতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন মহলে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একজন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জানান, ফুটপাত থেকে টাকা আদায়ের এখতিয়ার পুলিশের নেই। কিন্তু পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদা গ্রহণের অভিযোগ এলে আমরা অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
 

 
                            -20250318073629.jpg) 
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন