গত ১৫ বছরে সরকারপ্রণোদিত ‘সফলতা’র গল্প সাজাতে দেশের পাবলিক পরীক্ষার ফলব্যবস্থায় চলে এসেছে একপ্রকার নম্বরের কারসাজি। শিক্ষা বোর্ডের অঘোষিত নির্দেশে শিক্ষকদের বাধ্য করা হতো পরীক্ষার খাতা উদারভাবে দেখতে।
ফলে জিপিএ-৫ পাওয়ার হার বেড়েছে লাগামহীনভাবে। তবে ২০২৫ সাল থেকে সেই ধারায় টান পড়তে চলেছে।
অতীতের নির্দেশনা ছিল ‘যা-ই লিখুক, নম্বর ভালো দাও’
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে পরীক্ষা গ্রহণের পর খাতা দেখার সময় বোর্ড থেকে মৌখিকভাবে নির্দেশ আসত, ‘ছাত্র ফেল করলে তাদের মনোবল ভেঙে যাবে, পাস করাতে হবে’।
এমনকি অনেকে না লেখার পরও নম্বর পেতেন শুধু সহানুভূতির খাতিরে। এভাবে তৈরি হয়েছে একধরনের নম্বর-শোভিত ফল, যার পেছনে ছিল ‘রাজনৈতিক অর্জন’ দেখানোর প্রয়াস।
প্রধান পরীক্ষকেরা আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে পরীক্ষকদের বলতেন, বেশি নম্বর না দিলে ভবিষ্যতে পরীক্ষক হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
শিক্ষকেরাও নিরুপায় হয়ে বোর্ডের অনৈতিক এই ‘উদারতা’ মেনে নিতেন। কারণ এর সঙ্গে জড়িত ছিল বাড়তি অর্থ, সামাজিক সম্মান এবং প্রাইভেট টিউশনের বাজারমূল্য।
নম্বরের গোপন ছক
একজন পরীক্ষক জানান, খাতায় যদি ২০-এর বেশি নম্বর পেত কোনো শিক্ষার্থী, তাকে পাস করিয়ে দেওয়া হতো। ৪০ পেলে ৫০ বানানো, ৫০ পেলে ৬০ এবং ৭০ পেলে ৮০ নম্বর দেওয়া ছিল অলিখিত নিয়ম। এভাবে লাখ লাখ শিক্ষার্থী পেত ‘জিপিএ-৫’ যার অনেকেই বাস্তবে সেই যোগ্যতা রাখত না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষার্থীরা যখন এই সাজানো ফল নিয়েই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়, তখন প্রকৃত মেধার পরীক্ষা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৯৪ শতাংশই ফেল করে। অথচ এদের অনেকেই এসএসসি ও এইচএসসিতে পেয়েছিল জিপিএ-৫!
২০২৫ সাল থেকে নম্বর-উল্লম্ফনে লাগাম
চলতি বছর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড নতুন করে নির্দেশনা দিয়েছে, শিক্ষার্থীর যা প্রাপ্য, খাতায় কেবল ততটুকুই নম্বর দেওয়া যাবে।
উত্তর সঠিক না হলে নম্বর দেওয়া যাবে না। কোনো শিক্ষার্থীকে অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে সহানুভূতির নম্বর তুলে দেওয়া নিষিদ্ধ।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার জানিয়েছেন, ‘শিক্ষকদের আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে খাতায় যা লিখবে, তার ভিত্তিতেই নম্বর দিতে হবে। অতিরিক্ত নম্বর বা কম নম্বর, দুই-ই বন্ধ।’
১৫ বছরের নম্বর-উল্লম্ফনের পরিসংখ্যান
২০০১ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল মাত্র ৭৬ জন। ২০০৮ সালে তা দাঁড়ায় ৪১ হাজার ৯১৭ জনে। ২০১৪ সালের পর থেকে প্রতি বছর জিপিএ-৫ এর হার বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালে গিয়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ৬৯ হাজারে। যদিও ২০২৩ সালে তা কমে এক লাখ ৮৩ হাজারে আসে।
এইচএসসি ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা। ২০০৩ সালে প্রথমবার মাত্র ২০ জন জিপিএ-৫ পায়। অথচ ২০২১ সালে তা পৌঁছায় এক লাখ ৮৯ হাজারে। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে তা কমে দাঁড়ায় ৯২ হাজারে।
বেশি নম্বর দেওয়া ‘আত্মঘাতী উন্নয়ন’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বলেন, ‘সরকার ফল দিয়ে সফলতার ছবি আঁকতে চেয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এসএসসি বা এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েও বহু শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছে। এটা বুমেরাং আইডিয়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হলে শুধু নম্বর নয়, ক্লাসে পড়ালেখার পরিবেশ, শিক্ষকদের বেতন এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :