ঢাকা সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে জটিলতা কেন কাটছে না

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫, ১২:৫১ এএম
পাঠ্যবই। ছবি- সংগৃহীত

নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে বাকি মাত্র কয়েক মাস। তবে এখনো কাটেনি মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে জটিলতা। এনসিটিবি ও প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের মধ্যে দায়িত্ব ভাগাভাগি, টেন্ডার প্রক্রিয়ার বিলম্ব এবং প্রশাসনিক দ্বন্দ্বে আগামী বছর সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই পৌঁছানো নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

চলতি মাসে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু হলেও ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই ছাপা নিয়ে দরপত্র জটিলতা এবং নবম ও দশম শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার মূল্যায়ন শেষ না হওয়ায় মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই যথাসময়ে ছাপা ও সরবরাহ করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় বাড়ছে।

টেন্ডার জটেই মূল সমস্যা

এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক আবু নাসের টুকু জানিয়েছেন, ‘ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বই ছাপার দরপত্র আহ্বান করা হলেও নবম ও দশম শ্রেণির বইয়ের মূল্যায়ন এখনো চলমান। ডিসেম্বরের মধ্যে বই ছাপার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে, তবে সময় অত্যন্ত কম।’

এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। মুদ্রণ মালিকরা আন্তরিক হলে বছরের শুরুতেই বই সরবরাহ সম্ভব।’

প্রাথমিক বই ছাপার অগ্রগতি

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, প্রাথমিকের বই ছাপা নিয়ে তেমন সমস্যা নেই। এনসিটিবির পরিবর্তে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবার প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণ ও বিতরণের কাজ করছে। এনসিটিবি থেকে দায়িত্ব সরিয়ে এই উদ্যোগ আইন সংশোধনের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পথে।

এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মতিউর রহমান খান পাঠান জানান, ‘প্রি-প্রাইমারি, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার চুক্তি সম্পন্নের পথে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির জন্য নোয়া (NOA) ইস্যু করা হয়েছে। সময়মতো ছাপা ও বিতরণে সমস্যা হবে না।’

এনসিটিবিকে দুর্বল কী?

প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার দায়িত্ব এনসিটিবির কাছ থেকে সরিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের হাতে তুলে দেওয়ার এই উদ্যোগ নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। সংশ্লিষ্টদের একাংশ বলছেন, এনসিটিবির কিছু দুর্বলতা থাকলেও এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক কাঠামো। প্রতিষ্ঠানটিকে বাদ দিয়ে আলাদাভাবে বই ছাপার সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে সংকট বাড়াবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারিক মনজুর এই উদ্যোগকে ‘বাজে সিদ্ধান্ত’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতা দেওয়ার প্রবণতা শিক্ষাক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এনসিটিবিকে সংস্কার করে শক্তিশালী করা হোক, ভেঙে না ফেলে।’

সিদ্ধান্তের জট

২০২২ সাল থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ পৃথকভাবে বই ছাপার চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। এনসিটিবি দাবি করছে, অনেক সময় বই বিতরণে দেরি হয় মন্ত্রণালয়ের শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তে, যেমন ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে শেষ মুহূর্তে শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কারণে বই পৌঁছাতে তিন মাস দেরি হয়েছিল।

এবারও নভেম্বরের মধ্যে সব বই সরবরাহের পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু সরকার শেষ সময়ে মাধ্যমিকের তিন শ্রেণির বইয়ের দরপত্র বাতিল করায় সেই পরিকল্পনা অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

তদারকির ঘাটতি?

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান মনে করেন, ‘সময়মতো কাজ শুরু হলে বই ছাপা সম্ভব। কিন্তু শেষ দিকে জমিয়ে রাখার প্রবণতা ও তদারকির অভাবেই মানহীন বই সরবরাহের ঝুঁকি থাকে।’

তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকের বই ছোট, দ্রুত ছাপা সম্ভব। কিন্তু মাধ্যমিকের বইয়ের ক্ষেত্রে যদি ধারাবাহিকতা না থাকে, শেষ মুহূর্তে কাজ জমে গেলে আবারও সংকট তৈরি হবে।’

ভবিষ্যত পরিকল্পনা

বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে প্রয়োজনীয় বইয়ের সংখ্যা ৮ কোটি ৪৯ লাখ ২৫ হাজার, আর মাধ্যমিকে ২১ কোটি ৪০ লাখ। আগামী বছর এই বিপুল সংখ্যক বই সময়মতো ছাপা ও বিতরণে সফল হওয়া নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্ত, এনসিটিবির কার্যকারিতা এবং মুদ্রণ শিল্প মালিকদের সহযোগিতার উপর।

তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বর্তমান কাঠামো দুর্বল করে নতুন ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে হঠকারিতা ও সমন্বয়হীনতা আরও জটিলতা বাড়াতে পারে, যার চূড়ান্ত ভুক্তভোগী হবে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী।