ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০২৫

জিম সঙ্গীর বর্ণনায় এ. কে. রাতুলের অন্তিম মুহূর্ত

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২৫, ০৬:০১ পিএম
প্রয়াত সংগীতশিল্পী এ. কে. রাতুল। ছবি- সংগৃহীত

সবকিছুই ছিল প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক। জিমে শরীরচর্চা শেষ করে কিছুটা ক্লান্ত অনুভব করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি নিজেও হয়তো আঁচ করতে পারেননি কী অপেক্ষা করছে তার সামনে। এর পরের দৃশ্যপট যেন মৃত্যুর এক অমোঘ হাতছানি। বিস্ময় আর শোক মিলিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই দৃশ্যপটের বর্ণনা দেন এ. কে. রাতুলের ঘনিষ্ঠ এক জিম সঙ্গী, যিনি ঘটনার সময় তার পাশে ছিলেন। 

রোববার রাজধানীর উত্তরার চেরি ড্রপস জিমে দুপুর ৩টা ৩০মিনিটের দিকে নিয়মিত শরীরচর্চায় ব্যস্ত ছিলেন রাতুল। ব্যায়াম শেষ করে হাঁটু গেড়ে একটু বসেন। তখনই শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তার।  

সংগীতশিল্পী এ. কে. রাতুল। ছবি- সংগৃহীত

হালকা মাথা ঘোরা ও দুর্বলতা নিয়ে বসেন এক চেয়ারে। পাশে থাকা বন্ধুরা চিনির অভাব ভেবে চিনি খেতে দেন। তিনি খান, একটু পরেই স্বাভাবিক হন, হেসে কথা বলেন, তাদের সঙ্গে ঠাট্টাও করেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হলে বলেন ঘুম ঠিকমতো না হওয়া, আর ডায়েটিংয়ের কারণে চিনি কম খাওয়ায় শরীর হয়তো এমনটা করেছে। 

এক ব্যক্তি নিজেকে ‘ডাক্তার’ পরিচয় দিয়ে মোবাইলের আলো ফেলে তার চোখ পরীক্ষা করে বলেন, ‘সব ঠিক আছে।’ আশপাশের সবার বুকের ভেতর জমে থাকা ভয় কিছুটা কেটে যায়। কারণ তখনো রাতুলের মুখে ছিল হাসি, চোখে ছিল স্থিরতা।

 এ. কে. রাতুল। ছবি- সংগৃহীত

এর প্রায় পাঁচ মিনিট পর আরেক বন্ধু কাছে এসে জানতে চান, ‘ভাইয়া, এখন কেমন লাগছে?’ রাতুল হালকা হেসে উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, একদম ঠিক আছি। শুধু একটু মাথাব্যথা।’ এই কথায় চারপাশে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। সবাই ভাবেন, এবার হয়তো সব ঠিকঠাক।

কিন্তু মাত্র পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে সেই স্বস্তি রূপ নেয় চরম আতঙ্কে। চেয়ার থেকে উঠে রাতুল নিজেই গিয়ে বসেছিলেন অন্য একটি বেঞ্চে। হঠাৎ দেখা যায়, শরীর কাঁপছে।  একজন তাকে ডাকলেও কোনো সাড়া দেন না।

এ. কে. রাতুল। ছবি- সংগৃহীত

আর দেরি না করে তাকে তড়িঘড়ি করে রিকশায় তোলা হয়। সঙ্গে থাকা সেই ব্যক্তি সাহস দিতে থাকেন রাতুলকে। বলেন, ‘ভাই, শক্ত থাকেন, কিছু হবে না।’ 

তখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন রাতুল। কিন্তু একসময় হঠাৎ করেই থেমে যায় সেই নিঃশ্বাস। শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়, মাথা ঢলে পড়ে পাশে বসা সঙ্গীর কাঁধে। 

তিনি পরে সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, ‘আমার কাঁধে তখন ওনার নিথর মাথা, শরীরের সব ভার আমার ওপর পড়ে। বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা ভয়ংকর হয়ে গেছে; কিন্তু তখনো মন মানছিল না। ভাবছিলাম, হয়তো দুঃস্বপ্ন।’

ওউন্ডের সঙ্গে এ. কে. রাতুল। ছবি- সংগৃহীত

সেই মর্মান্তিক মুহূর্তের বর্ণনায় তিনি আরও বলেন, ‘দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার, কথা বলতে পারছিলেন না। আমি বুঝতে পারছিলাম, কিছু একটা ভয়ংকর ঘটছে। পাশে বসিয়ে তাকে পানি দিই, বুক চেপে দিই। একটু পরে ও চোখ বন্ধ করে ফেলে। তারপর আর জ্ঞান ফেরেনি।’

তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় বনানীর নিকটবর্তী ক্রিসেন্ট হাসপাতালে, সময় লেগেছিল মাত্র ৩-৪ মিনিট। কিন্তু সেখানে গিয়ে ঘটে আরেক হৃদয়বিদারক অধ্যায়। উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ক্রিসেন্ট হাসপাতালের কর্মীরা কোনোমতে নাড়ি দেখেই বলেন, ‘তিনি আর নেই।’ তবু হাল না ছেড়ে এরপর তাকে নেওয়া হয় লুবানা জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে সবকিছু।

 এ. কে. রাতুল। ছবি- সংগৃহীত

এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে পরে আরেকটি পোস্টে ওই ব্যক্তি লেখেন, ‘তিনি আমার কোলেই মারা যান, যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম! কয়েক মিনিট আগেও হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘ভালো আছি।’ সেই শেষ হাসিটা কোনোভাবেই ভুলতে পারছি না! দুঃস্বপ্নের মতো এক বিভীষিকাময় দিন ছিল এটা! আল্লাহ যেন তার আত্মাকে শান্তি ও মাগফিরাত দান করেন!’

এ. কে. রাতুল, স্মৃতিতে অমলিন। ছবি- সংগৃহীত

এ. কে. রাতুলের চলে যাওয়া কেবল একটি প্রাণের অবসান নয়, এটি এক আদর্শিক সংগীতযোদ্ধার নিঃশব্দ বিদায়। তার মতো মানুষের শূন্যতা কেবল গানেই নয়, অনুভব হবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো সেই নিঃশব্দ কণ্ঠে, যা আর শোনা যাবে না কখনো।