মুম্বাইয়ের খেতওয়াড়ির আরব বাংলোয় প্রস্তুতি চলছিল এক জাঁকজমকপূর্ণ উদযাপনের। কারণ, সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘২৭ ডাউন’ একাই জিতেছে দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সেই আনন্দের কেন্দ্রে ছিলেন ছবিটির তরুণ ও প্রতিভাবান পরিচালক অবতার কৃষ্ণ কৌল। অতিথিরা অপেক্ষায়— কখন আসবেন তিনি, কখন শুরু হবে উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত। কিন্তু ঠিক তখনই সেই আনন্দঘন আবহে ছায়া ফেলে এক ফোনকল। জানানো হয়, সমুদ্র থেকে উদ্ধার হওয়া একটি মৃতদেহ শনাক্ত করা হয়েছে- সেটি আর কেউ নন, অবতার কৌল স্বয়ং। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে যাকে মরতে হয়।
বেদনায় গড়ে ওঠা জীবন
১৯৩৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, কাশ্মীরের শ্রীনগরে জন্ম নিয়েছিলেন অবতার। ছয় ভাইবোনের পরিবারে শৈশব কাটে নানাবাড়িতে, যেখানে দাদা-দাদির স্নেহ ছিল তার জীবনের একমাত্র আশ্রয়। কিন্তু নানা অবসরে যাওয়ার পর দিল্লিতে ফিরে আসতে হয়। সেখানেই শুরু হয় তার কঠিন সময়। অবতরের পিতা, যিনি রোজ তার স্ত্রী ও সন্তানদের নির্যাতন করতেন, বাড়ি থেকে বের করে দিতেন। একদিন সেই পিতার রোষে পড়ে ঘর ছাড়া হন অবতার নিজেও। ঠাঁই মেলে দিল্লি রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, পরে এক চায়ের দোকানে কাজ। জীবনের কঠিন এই অধ্যায়ই তার ভেতরে জন্ম দেয় গভীর সংবেদনশীলতা- যা পরবর্তীতে ফুটে ওঠে তার চলচ্চিত্রে।
নিউ ইয়র্কের অধ্যায়
আস্তে আস্তে নিজেকে গুছিয়ে নেন অবতার। আম্বালায় একটি হোটেলে কাজের সুযোগ পান, সেখানে পূর্ণ পেট খেতে পারা তাকে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখায়। এরপর উন্মুক্ত শিক্ষায় স্নাতক হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন এবং ১৯৬০ সালে পোস্টিং পান নিউইয়র্কে। সেখানেই শুরু হয় তার প্রকৃত রূপান্তর। দিনভর চাকরি, আর রাতভর সিনেমা ও সাহিত্যে নিমগ্ন থাকা এক তরুণ। ভর্তি হন নিউইয়র্কের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে, পরে সিটি ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্ক থেকে সিনেমায় গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।
সেখানেই পরিচয় হয় তার স্ত্রী অ্যানের সঙ্গে। তারা কিছু বছর পর ভারতে ফিরে আসেন। ১৯৭০ সালে মারচেন্ট-আইভরি প্রোডাকশনের ‘বম্বে টকি’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করে শুরু হয় তার চলচ্চিত্রের পথচলা।
‘২৭ ডাউন’
১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় তার একমাত্র পরিচালিত ছবি- ‘২৭ ডাউন’। রমেশ বক্সীর উপন্যাস ‘অথরা সুরজ কে পৌধে’ অবলম্বনে নির্মিত এই ছবি এক তরুণ রেলকর্মীর নিঃসঙ্গতা, প্রেম এবং সমাজের চাপে তার ভেতরে চলতে থাকা দ্বন্দ্বের গল্প। ওম পুরী ও রাখি অভিনীত এই ছবি এক নিঃশব্দ বিপ্লব। সাদাকালো চিত্রগ্রহণ, বাস্তব লোকেশন, ন্যাচারাল আলো আর ডকুমেন্টারি স্টাইলের ক্যামেরার কাজ- সব মিলিয়ে ‘২৭ ডাউন’ হয়ে ওঠে ভারতের নিউ ওয়েভ সিনেমার এক মাইলফলক।
চিত্রগ্রাহক এ.কে. বীরের ক্যামেরার কাজ প্রশংসিত হয় আন্তর্জাতিকভাবেও। রাখি গুলজার নিজের শাড়িতে, বিনা মেকআপে শুটিং করেন, কারণ তিনি চিত্রনাট্যে ভালোবেসে অভিনয় করতে রাজি হন বিনা পারিশ্রমিকে।
পুরস্কার ও মৃত্যুর নির্মম সমাপতন
‘২৭ ডাউন’ ১৯৭৪ সালে সেরা হিন্দি ফিচার ফিল্ম এবং সেরা চিত্রগ্রহণ বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতে। লোকার্নো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পায় একুমেনিক্যাল পুরস্কার। কিন্তু এই সাফল্য উদযাপনের আগেই আসে নির্মম পরিণতি- রিচালক অবতার কৌলের মৃত্যু। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আজও অস্পষ্ট- জলে ডুবে যাওয়া নাকি কিছু অন্য রহস্য?
এই ক্ষতি তার পরিবারকে চুরমার করে দেয়। তার মা ভেঙে পড়েন, ভাই মানসিক আঘাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরিবারের যে ভাই তার সিনেমা প্রযোজনায় সহায়তা করতে চাকরি ছেড়েছিলেন, তাকেও হতাশার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। একটি সম্ভাবনার হঠাৎ নিভে যাওয়া শুধু পরিবার নয়, ভারতীয় চলচ্চিত্রের জন্যও এক অপূরণীয় ক্ষতি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন