সিঙ্গাপুরে শাংরি-লা সংলাপে যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনার ছায়ায় এবার প্রকাশ পেল নতুন বিভাজন। অর্থাৎ এশিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব।
শনিবার (৩১ মে) এক ভাষণে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ চীনকে ‘আসন্ন হুমকি’ বলে আখ্যা দিলেও ইউরোপীয় দেশগুলোকে ইউরোপেই প্রতিরক্ষা খরচ বাড়ানোর আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, ইউরোপের প্রতিরক্ষা বাজেটের বড় অংশ ইউরোপেই থাকুক… যাতে আমরা আমাদের তুলনামূলক সুবিধা কাজে লাগিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আমাদের অংশীদারদের সহায়তা করতে পারি।’
চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডং জুনের অনুপস্থিতি ও তার পরিবর্তে সামরিক গবেষকদের একটি নিম্ন-পর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠানোর কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি কিন্তু দূরত্বে
চার দিন ধরে সীমান্তে সংঘর্ষের পর গত ১০ মে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত হয়। সিঙ্গাপুরের ওই সম্মেলনে ভারত ও পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু উভয় দেশের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে একে অপরের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে ইউরোপের দ্বিধা
যুক্তরাষ্ট্র চাইলেও কিছু ইউরোপীয় দেশগুলো স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক কায়া কাল্লাস বলেন, ‘ইউরোপ ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের নিরাপত্তা একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি আপনি চীন নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, তবে রাশিয়া নিয়েও হওয়া উচিত।’ এই বলে তিনি ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধে চীনের সহায়তা ও উত্তর কোরিয়ার সৈন্য মোতায়েনের কথাও তুলে ধরেন।
ফ্রান্সের ভিন্ন পথ
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, ফ্রান্স ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি শক্তি। কারণ তার অঞ্চলিক উপস্থিতি নিউ ক্যালেডোনিয়া ও ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ায় রয়েছে এবং সেখানে ফরাসি সেনাদের ঘাঁটি আছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা চীন বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই নই এবং আমরা কারো ওপর নির্ভর করতে চাই না। আমরা একটি ‘তৃতীয় পথ’ চাই—যেখানে ইউরোপ ও এশিয়া একসঙ্গে কাজ করে।’
ইউরোপীয় সামরিক উপস্থিতি সরানো সহজ নয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপীয় সেনা ও প্রতিরক্ষা খাতে অনেক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে, যেগুলো হঠাৎ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
ব্রিটিশ একটি বিমানবাহী রণতরী চলতি মাসেই সিঙ্গাপুরে পৌঁছাবে। আর এ জন্য ২০১৭ সালেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এটি দক্ষিণ চীন সাগরে মুক্ত নৌ-চলাচলের প্রতি ব্রিটেনের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরবে।
এই সফর ৫৪ বছর পুরোনো ‘ফাইভ-পাওয়ার ডিফেন্স অ্যারেঞ্জমেন্ট’-এর অংশ, যেখানে ব্রিটেন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড একসঙ্গে সামরিক সহযোগিতা করে।
ব্রিটেনের মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে পুরোনো সামরিক চুক্তিও আছে।
সিঙ্গাপুরের ২০০ জন কর্মী বর্তমানে ফ্রান্সে ১২টি হালকা যুদ্ধবিমান পরিচালনা করে। ব্রিটেনের ব্রুনেইতে একটি জঙ্গল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও এক হাজার ২০০ সদস্যের গুর্খা ব্যাটালিয়ন রয়েছে।
এশিয়ায় ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা শিল্পের দখল
লন্ডনভিত্তিক আইআইএসএসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এয়ারবাস, ডামেন, নেভাল গ্রুপ ও থালেস-সহ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর দীর্ঘদিনের উপস্থিতি এশিয়ায় রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফিনক্যান্টিয়েরি (ইতালি) ও সাব (সুইডেন)-এর মতো নতুন কোম্পানিও বাজারে প্রবেশ করেছে।
সাব এখন থাইল্যান্ডে তাদের গ্রিপেন যুদ্ধবিমান বিক্রির দ্বারপ্রান্তে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল মার্কিন কোম্পানি লকহিড মার্টিনের এফ-১৬।
স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) জানায়, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যয় ৪৬ শতাংশ বেড়ে ৬২৯ বিলিয়ন ডলারে ছুঁয়েছে।
ফিনল্যান্ডের প্রতিক্রিয়া: রাশিয়া এখনো মূল হুমকি
ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অন্তি হাক্কানেন বলেন, ‘ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে ইন্দো-প্যাসিফিকে সম্পদ পাঠানো কঠিন।’ তার মতে, ইউরোপীয় দেশগুলোর এখন মূল মনোযোগ হওয়া উচিত ইউরোপের প্রতিরক্ষা জোরদার করা, যেন যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিকে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
সম্মেলনে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইউরোপ যেন তার নিজের নিরাপত্তায় মনোযোগ দেয়, যাতে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় বেশি জোর দিতে পারে। কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলো বলছে, তারা দুই জায়গাতেই থাকতে চায়।
আপনার মতামত লিখুন :