ঢাকা শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫

আমরা ভয় পেলেও কেন হরর সিনেমা দেখতে পছন্দ করি?

ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২৫, ০৬:২৭ পিএম
ভয়ের সিনেমা দেখার দৃশ্য। ছবি - সংগৃহীত

রাতের অন্ধকারে মুখোশধারী খুনি তার শিকারের পিছনে ছুটছে। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে হিংস্র জম্বিরা। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসছে অদৃশ্য ভূত। বাস্তবে এমন দৃশ্য ঘটলে আমরা চিৎকার করে পালাতাম- অথচ সিনেমা হলে একই দৃশ্য দেখে আমরা মুগ্ধ হই, আঁকড়ে ধরি পাশের মানুষটিকে, আবারও দেখি। প্রশ্ন জাগে- মানুষ কেন ভয় পেতে ভালোবাসে?

ভয় আমাদের শত্রু নয়, বরং টিকে থাকার একটি প্রাকৃতিক উপায়। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, ভয়ের সময় শরীরে সক্রিয় হয় লড়াই-অর-ফ্লাইট প্রতিক্রিয়া। ভৌতিক সিনেমা সেই প্রতিক্রিয়াটাকেই নিরাপদভাবে উদ্দীপিত করে, যেন আমরা বিপদের মুখোমুখি হচ্ছি- কিন্তু জানি, পর্দার বাইরেই আমরা নিরাপদ।

নিউরোসিনেমেটিক্স গবেষণায় দেখা গেছে, ‘জাম্প স্কেয়ার’ বা হঠাৎ ভয় দেখানো দৃশ্য মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা অংশে তীব্র কার্যকলাপ সৃষ্টি করে- যা বিপদ শনাক্ত করে এবং শরীরকে প্রস্তুত করে। কিন্তু বিপদ কল্পিত হওয়ায়, আতঙ্কের পর মস্তিষ্ক ডোপামিন নিঃসরণ করে, তৈরি হয় আনন্দ ও মুক্তির অনুভূতি। অর্থাৎ, আমরা ভয় পাই, বেঁচে যাই, আর তারপর মস্তিষ্ক বলে — ‘ওয়াও, এটা দারুণ ছিল!’

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ বারবার ভয়ের সিনেমার দিকে ফিরে আসে তিনটি কারণে। প্রথমত, টেনশন- ভৌতিক সিনেমা দর্শককে সবসময় প্রান্তে রাখে। সাসপেন্স, রহস্য, রক্তপাত- সবই তৈরি করে এক ধরণের মানসিক উত্তেজনা, যা অনেকের কাছে নেশার মতো।

দ্বিতীয়ত, প্রাসঙ্গিকতা- এই সিনেমাগুলো প্রায়ই সমাজ, মৃত্যু বা অজানার ভয় নিয়ে প্রতিফলন ঘটায়। এর বড় প্রমাণ- ‘গেট আউট’ বেরিয়ে যাও ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমাটি বর্ণবাদের ভয়কে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরে মানুষের মধ্যে।

তৃতীয়ত, অবাস্তবতা- আমরা জানি, যা দেখছি তা কল্পনা। ফলে ভয় বাস্তব নয়, কিন্তু উত্তেজনা সত্যি। এ কারণেই আমাদের আগ্রহ বাড়ে সিনেমার প্রতি।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘ভয় নিজে সহজাত নয়, শেখা হয়। মানুষ জন্মগতভাবে শুধু আনন্দ বা ব্যথার মতো মৌলিক অনুভূতি নিয়ে আসে, কিন্তু ‘ভয়’ শিখে নেয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।

গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কে কোনো একক ভয় কেন্দ্র নেই; বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী বিভিন্ন অঞ্চল সক্রিয় হয় তখন সবটা জুড়ে ভয় সৃষ্টি হয়। বাস্তবে বিপদে এবং সিনেমার ভয়ের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন, কিন্তু শরীরিক প্রতিক্রিয়া অনেকটা একই।

গবেষকরা বলেন, ‘যখন আমরা জানি বিপদটা সিমুলেশন, তখনো শরীরের সেন্সরি সিস্টেম কাজ করে, কিন্তু আমরা সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করি। এজন্যই সিনেমার ভয় উত্তেজক, কিন্তু সহনীয়।’

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, কিছু মানুষ স্বেচ্ছায় ‘ভয়’ বা ‘ব্যথা’র অভিজ্ঞতা নিতে চায়, কারণ এরপর মস্তিষ্ক এন্ডোরফিন নিঃসরণ করে- যা এক ধরনের প্রাকৃতিক আনন্দ হরমোন। কেননা ভয় কাটিয়ে ওঠার পর যে মুক্তির অনুভূতি আসে, সেটিই মানুষকে আবারও সেই অভিজ্ঞতার দিকে টানে।’

ভৌতিক সিনেমা কেবল বিনোদন নয়; এটি এক ধরণের মানসিক প্রশিক্ষণও হতে পারে ‘বিদ্বেষপূর্ণ ভয়’- অর্থাৎ পরোক্ষ ভয়। মস্তিষ্ক এসব কল্পিত পরিস্থিতিকে ‘অনুশীলন’ হিসেবে ব্যবহার করে, যাতে বাস্তবে বিপদ এলে কীভাবে আচরণ করতে হবে তা আগেই শিখে ফেলে।

ভৌতিক সিনেমা শুধু স্নায়ুবিদ্যার খেলা নয়, এটি সমাজের আয়নাও। চলচ্চিত্র গবেষক কেন্ডাল ফিলিপস, A Cinema of Hopelessness বইয়ের লেখক, বলেন, ‘ভৌতিক সিনেমা মানুষকে তাদের বাস্তব ভয়গুলো প্রক্রিয়াকরণে সাহায্য করে- রাজনৈতিক, সামাজিক বা অস্তিত্বগত।’

তিনি দেখিয়েছেন, ১৯৩১ সালের ড্রাকুলা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক Barbarian (২০২২) ও Smile (২০২২) পর্যন্ত, ভৌতিক ধারার জনপ্রিয়তা কখনো কমেনি। করোনা মহামারির পরও, যখন থিয়েটার দর্শক হারাচ্ছিল, তখনো এই সিনেমাগুলো বক্স অফিসে টিকে ছিল- কারণ, ভয় আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আমাদের প্রিয় ভৌতিক সিনেমাগুলো- শুধু ভয় দেখায় না, আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। ভৌতিক সিনেমা এক ধরনের নিরাপদ ঝুঁকি, যেখানে আমরা অজানার মুখোমুখি হই, তবুও জানি- হলের আলো জ্বলে উঠলেই সব ঠিক। এই নিয়ন্ত্রিত আতঙ্কই আমাদের আনন্দ দেয়, মুক্তি দেয়, আর পরবর্তী ভয়ের অপেক্ষায় রাখে।