‘মানুষ হওয়ার অর্থ কী?’- এটি এমন একটি সাধারণ প্রশ্ন যা কয়েকটি শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তবে মানব জীবনের জটিলতা, দ্বন্দ্ব ও রহস্যের সমগ্র ধারাকে উন্মোচন করে এই শব্দগুচ্ছ। হাজার হাজার বছর ধরে আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। কবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, শিল্পী- সবার চেষ্টা, কিন্তু কেউই মানব অভিজ্ঞতার গভীরতা সম্পূর্ণভাবে বোঝার কাছে পৌঁছাতে পারেননি। তবে কিছু মানুষ অন্যদের তুলনায় ভিন্ন। তারা আরও জ্ঞানী, আরও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, এবং সময়ের চেয়ে একধাপ এগিয়ে।
চার্লস ডারউইন আমাদের প্রজাতির অবস্থার অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছেন, হাজার বছরের চিন্তাধারাকে এক ঝটকায় বদলে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি মানুষ হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতার গভীরতা ব্যাখ্যা করতে পারেননি। কয়েক দশক পরে সিগমুন্ড ফ্রয়েড অবচেতন মনের রহস্যের দিকে নজর দিয়েছিলেন, তবে তিনিও চেতনার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হন।
বাস্তবে আজও কেউ তার জীবনের অসাধারণ বিস্ময় মুহূর্ত, প্রেমের উত্তেজনা, ভালো কোনো আলোচনা শুনে আত্মার আলোড়ন, কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার মুহূর্ত সম্পূর্ণভাবে বর্ণনা করতে পারেননি।
‘বিইং হিউম্যান’ আমাদেরকে মানুষ হওয়ার রহস্যের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাবে। এটি জানাবে আমরা কেন এমন আচরণ করি, কীভাবে আরও ভালোভাবে বাঁচতে পারি, আমরা কতদূর পৌঁছেছি, এবং আমাদের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে।
ইতিহাস বলছে, প্রায় ১০০,০০০ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকার শুষ্ক সাভানা থেকে। আমরা সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী ছিলাম না, তবে আমাদের মস্তিষ্ক বড় এবং হাতের দক্ষতা অসাধারণ ছিল। হাতিয়ার তৈরি করা শুরু করি, যা আমাদের বন্য পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য সহায়ক হয়।
পরে আমাদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ ঘটে, তা হলো ভাষা। আমরা কেবল শব্দ নয়, ধারণা প্রকাশ করতে শিখি। আশা, ভালোবাসা, বিপদ- সবই আমরা বলতে শিখি। গল্প বলা শুরু করি, আমাদের অস্তিত্ব ও জীবনের অর্থ বোঝার প্রচেষ্টা চালাই।
প্রায় বারো হাজার বছর আগে কৃষি উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমরা স্থায়ী বসতি স্থাপন করি। সমাজ, রাজ্য, অর্থনীতি- সবই গড়ে ওঠে। ২৫০০ বছর আগে আমরা বড় প্রশ্ন করতে শুরু করি: ‘কীভাবে ভালোভাবে বাঁচা যায়? মানুষ হওয়ার অর্থ কী?’ এ প্রশ্নের উত্তরেই আমাদের সভ্যতা, শিল্প ও দর্শনের বিকাশ ঘটে।
পাঁচশ বছর আগে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব আমাদের জীবনকে দীর্ঘ ও ফলপ্রসূ করার সুযোগ দেয়। মাত্র ৫০ বছর আগে ডিজিটাল বিপ্লব পৃথিবীকে একটি ‘গ্লোবাল গ্রাম’ বানায়। আজ আমরা এমন শক্তিশালী যে পৃথিবীকে ধ্বংস ও জীবন সৃষ্টি করার ক্ষমতা অর্জন করেছি।
জীববিজ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানব চেতনার সীমা চ্যালেঞ্জ করছে। সোফিয়া, একটি প্রাণবন্ত রোবট, মানুষের মতো দেখতে ও কথা বলতে পারে, কিন্তু মানব অনুভূতি ও চিন্তাভাবনা অর্জন করতে পারেনি। প্রশ্ন উঠছে- কত বছর পর সে সত্যিকারের মানুষ হতে পারবে? নাকি আমরা এরই মধ্যে তাদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছি?
মানুষ হওয়ার গল্প অসাধারণ। এটি আমাদের প্রজাতির ইতিহাস, কিন্তু সেই সঙ্গে প্রতিটি ব্যক্তির জীবনকথারও গল্প। আশা, ভয়, প্রেম, হতাশা- সবই মিলে আমাদের বেঁচে থাকার বিস্ময় তৈরি করে। আমরা অদৃশ্য পাদটীকা হয়ে মহাবিশ্বের একটি ধুলোর কণা হলেও, আমাদের নিজস্ব মহাবিশ্বের কেন্দ্রে থাকার সৌভাগ্যই মানুষ হওয়ার সবচেয়ে বড় রহস্য।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন