করপোরেট জীবনধারা মানুষের স্বাস্থ্যবিধিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। অফিসের ভেতর দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ ও অপর্যাপ্ত ঘুম এই সব মিলেই বাড়ছে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি। চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, অফিস-ভিত্তিক জীবনযাপনে শরীরের সাধারণ গতিশীলতা কমে যাওয়ার ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।
জীবনযাপনের কারণে রোগ
চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র পুষ্টি কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ডায়াবেটিসকে নন-কমিউনিকেবল বা লাইফস্টাইল ডিজিজ বলা হয়। এটি কখনো সম্পূর্ণ আরোগ্য হয় না, তবে জীবনযাপনে পরিবর্তন এনে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় হলো খাদ্য, নিয়ম এবং ওষুধ।
তিনি আরও বলেন, অফিসে বসে কাজের সময় অন্তত প্রতি ঘণ্টায় উঠুন, হাঁটুন। নিয়মিত পানি পান করুন এবং ফাস্ট ফুড ও সফট ড্রিঙ্ক এড়িয়ে চলুন। নিয়মিত রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করাও জরুরি।
সিটিং ইজ দ্য নিউ স্মোকিং
অফিস ডেস্কে একটানা ৬-৮ ঘণ্টা বসে কাজ করা এখন সাধারণ অভ্যাস। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিয়মিত বসে থাকার সময় যত বাড়ে, ইনসুলিন কার্যকারিতা তত কমে যায়। ফলে শরীরে শর্করা বিপাকে সমস্যা দেখা দেয় এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। অনেক ক্ষেত্রে বসে থাকা রক্তচাপ, হৃদরোগ ও স্থূলতার ঝুঁকিও বাড়ায়।
ফাস্টফুডে নির্ভরতা ও ভুল খাদ্যাভ্যাস
করপোরেট কর্মজীবীরা সময়ের অভাব বা ব্যস্ততার কারণে ঝটপট ফাস্টফুড, প্রসেসড খাবার, প্যাকেটজাত জুস ও সফট ড্রিঙ্কের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এসব খাবারে থাকে উচ্চ ক্যালরি ও চিনি। অফিসে বারবার চা বা কফি খাওয়ার সঙ্গে বিস্কুট বা স্ন্যাকসও খাওয়া হয়, যা রক্তে শর্করাকে হঠাৎ বাড়িয়ে দেয়।
পুষ্টিবিদের মতে, প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এসব খাবারের আধিক্য ওজনে বৃদ্ধির পাশাপাশি শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে ডায়াবেটিসের পথ তৈরি করে।
অনিয়মিত বা কম ঘুম
দীর্ঘদিন সময় ধরে কাজের কারণে ঘুমের সময় কমিয়ে দিলে ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ করে না। কর্টিসল বা স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা বাড়িয়ে দেয় ক্ষুধা ও শর্করার আকাঙ্ক্ষা। এছাড়া, যেসব কর্মী অফিস থেকে ফিরেও মোবাইল বা ল্যাপটপে কাজ চালিয়ে যান, তাঁদের ঘুম ব্যাহত হয়। এটি দীর্ঘমেয়াদে ডায়াবেটিস ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
সকালের খাবার বাদ দেওয়ার বিপদ
অনেকে অফিসের তাড়ায় সকালের খাবার খাওয়ার সময় পান না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সকালের খাবার না খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা ওঠানামা করে এবং পরবর্তীতে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এটি ওজন বাড়িয়ে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে।
মানসিক চাপও এক নিঃশব্দ বিপদ
অফিসের সময়সীমা, ধকল, দায়িত্বসীমা এবং লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চাপ সব মিলে অনেক কর্মচারীর মানসিক চাপ বাড়ে। নিয়মিত মানসিক চাপ কর্টিসল হরমোন বাড়িয়ে ডায়াবেটিসের পথ তৈরি করে। এর কারণে শরীর অতিরিক্ত গ্লুকোজ তৈরি করে এবং ইনসুলিনের ব্যবহার কমে যায়।
কী করবেন?
অফিসে প্রতি ঘণ্টায় ৫ মিনিট দাঁড়িয়ে হাঁটুন। প্রক্রিয়াজাত খাবার ও সফট ড্রিঙ্ক কমান। পর্যাপ্ত পানি পান করুন। ব্যস্ততার মাঝেই প্রয়োজনে খাবার সময় ব্যবস্থাপন করুন। নিয়মিত ব্যায়াম, ধ্যান ও বিশ্রাম নিন। ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করুন। রক্তে শর্করা পরীক্ষার অভ্যাস করুন।
অফিস কেন্দ্রিক থাকায় শারীরিক গতিশীলতা, খাদ্যাভ্যাস ও ঘুমের নিয়মের ওপর যতটা চাপ পড়ে, ততটাই স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনাও বাড়ে। তাই কর্মজীবী মানুষের প্রয়োজন সচেতনতা ও সঠিক রুটিন। জীবনযাপনের অল্প কিছু পরিবর্তন নিয়মিত হাঁটা, স্বাস্থ্যকর খাবার, সময়মতো ঘুম দিয়ে ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য জীবনযাপনজনিত রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন