মসলাদার বিচ্ছু, ভাজা উইপোকা, ট্যারান্টুলার ফ্রাই কিংবা কৃমির স্যুপ বিশ্বের নানা প্রান্তে অদ্ভুত সব খাবারের কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু এমন কোনো খাবারের কথা কি কল্পনা করা যায়, যার মূল উপাদানই হলো শক্ত নুড়ি পাথর?
যে পাথর ভাতের থালা থেকে আমরা সযত্নে তুলে ফেলে দিই, সেটিই যখন হয়ে ওঠে একটি জনপ্রিয় পদের মূল আকর্ষণ, তখন অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। অবিশ্বাস্য শোনালেও চীনের রাস্তায় এখন চুটিয়ে বিক্রি হচ্ছে এমনই এক খাবার, যার নাম ‘সুওডিউ’।
‘সুওডিউ’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো ‘চুষে ফেলে দাও’। নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই খাবার উপভোগ করার অনন্য কৌশল। এটি বিশ্বের একমাত্র খাবার যা চিবিয়ে খাওয়ার দুঃসাহস কেউ করে না, কারণ এর মূল উপাদান নদীর মসৃণ নুড়ি পাথর। তাহলে কীভাবে খাওয়া হয় এটি?
প্রথমে গরম গরম পরিবেশন করা সুগন্ধি মশলায় মাখানো পাথরগুলোকে একটি একটি করে মুখে নিয়ে চুষে এর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। মশলার ঝাল, মিষ্টি ও নোনতা স্বাদের আস্তরণটি হয়ে গেলে পাথরটি ফেলে দেওয়া হয়। এভাবে পাত্রের সব পাথর চুষে শেষ করার পর নিচে যে ঘন, সুস্বাদু ঝোলটি অবশিষ্ট থাকে, সেটিই এই পদের চূড়ান্ত আকর্ষণ।
চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে এই পদের উৎপত্তি হলেও এখন এটি দেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তার পাশের খাবারের দোকানগুলোতে তুমুল জনপ্রিয়। তৈরির প্রক্রিয়াটিও বেশ আকর্ষণীয়। প্রথমে নদীর তীর থেকে মসৃণ ও চ্যাপ্টা আকারের নুড়ি পাথর সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেগুলোকে অত্যন্ত যত্ন সহকারে ধুয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়। একটি বড় তাওয়ায় তেল গরম করে তাতে পেঁয়াজ, রসুন, মরিচের সস, টমেটো এবং বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় মশলা দিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করা হয়।
এরপর সেই ফুটন্ত মশলার মিশ্রণে পরিষ্কার নুড়ি পাথরগুলো ছেড়ে দিয়ে ভালোভাবে ভাজা বা কষানো হয়, যতক্ষণ না প্রতিটি পাথরের গায়ে মশলার একটি পুরু আস্তরণ তৈরি হয়। গরম গরম ধোঁয়া ওঠা এই ‘পাথরের তরকারি’ ছোট বাটিতে করে পরিবেশন করা হয়। চীনে এক প্লেট সুওডিউ খেতে খরচ হয় বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৫০ টাকা।
শত শত বছরের পুরনো ইতিহাস
সুওডিউ কোনো আধুনিক বা খামখেয়ালি খাবার নয়। এর পেছনে লুকিয়ে আছে শত শত বছরের এক পুরনো ইতিহাস। মনে করা হয়, এর উৎপত্তি হয়েছিল চীনের প্রাচীন মাঝি সম্প্রদায়ের হাত ধরে। যখন মাঝিরা দীর্ঘদিনের জন্য নৌকায় করে নদীপথে যাত্রা করতেন, তখন অনেক সময়ই তাদের খাবার ফুরিয়ে যেত বা রসদ নষ্ট হয়ে যেত।
সেই কঠিন সময়ে ক্ষুধা মেটাতে এবং মুখে স্বাদ ফিরিয়ে আনতে তারা নদীর নুড়ি পাথরকেই বানিয়ে নিতেন তাদের খাবার। পাথরগুলোকে বিভিন্ন লতাপাতা ও সঙ্গে থাকা সামান্য মশলা দিয়ে রান্না করে তার স্বাদ চুষে খেতেন তারা। পাথরের খনিজ উপাদান এবং মশলার স্বাদ তাদের শরীরে কিছুটা শক্তি জোগাত এবং খাবারের অভাব ভুলিয়ে রাখত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই রেসিপি মুখে মুখে টিকে ছিল।
সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল এবং নতুন করে জনপ্রিয়তা
বহুদিন প্রচারের আড়ালে থাকলেও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে ‘সুওডিউ’ আবার আলোচনায় উঠে এসেছে। সুওডিউ রান্না করার এবং খাওয়ার নানা ভিডিও টিকটক, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল হওয়ার পর সারা বিশ্বের খাদ্যপ্রেমীদের মধ্যেই এটি নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
এটি এখন আর কেবল ক্ষুধা মেটানোর উপায় নয়, বরং চীনের এক ঐতিহ্যবাহী ও অনন্য অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে উঠেছে। খাদ্যরসিকরা শুধু এর স্বাদ নিতেই নয়, এর পেছনের গল্প এবং ইতিহাসকে উপভোগ করতেই এই অদ্ভুত সুন্দর পদটির দিকে ঝুঁকছেন। সুওডিউ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, খাবার কেবল পেট ভরানোর জন্য নয়, এটি একটি সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং মানুষের টিকে থাকার সংগ্রামের এক জীবন্ত দলিল।