আন্দিজ পর্বতের বুক চিরে, মেঘ আর নীল আকাশের মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মাচু পিচু- ইতিহাসের এক নিঃশব্দ সাক্ষ্য। পেরুর কুজকো শহর থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,৪০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই প্রাচীন ইনকা শহর যেন নিজেই এক রহস্য। ‘মাচু’ মানে পুরাতন, ‘পিচু’ মানে পর্বত- দুই মিলে হয় ‘পুরাতন পর্বত’। নামের মতোই এটি সময়ের ঘন ধুলোর নিচে ছিল অনেক বছর, যতক্ষণ না ১৯১১ সালে হিরাম বিংহাম নামের এক আমেরিকান অধ্যাপক এর ধ্বংসাবশেষ পুনরাবিষ্কার করেন।
মাচু পিচুর জন্ম হয়েছিল ইনকা সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সময়ে, ১৫ শতকে। সম্রাট পাচাকুতি ইনকা ইউপানকির শাসনামলে এটি নির্মাণ করা হয় এক রাজকীয় আশ্রয়স্থল হিসেবে। এটি শুধু বসবাসের জায়গা ছিল না, ছিল রাজনীতি, ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতার মিলনস্থল। প্রকৃতির সঙ্গে এমন চমৎকার সামঞ্জস্য রেখে তৈরি শহর পৃথিবীতে খুব কমই আছে। এখানে সূর্যের আলো, ছায়া আর পাথরের খেলা যেন এক অপূর্ব জ্যামিতির সৃষ্টি করেছে।
মাচু পিচুর পুরো গঠনটিই এক বিস্ময়। এখানে রয়েছে সূর্য মন্দির, ইন্তিহুয়াটানা পাথর (যা দিয়ে ইনকারা সময় মেপে নিত), তিন জানালার হল, সেন্ট্রাল প্লাজা, রাজকীয় সমাধি, কনডোরের মন্দির, জলের ঝর্ণা এবং আরও অনেক নিখুঁতভাবে নির্মিত কাঠামো। পাহাড়ের ঢালে তৈরি সোপানগুলো কেবল কৃষির সুবিধার জন্যই নয়, বরং ভূমিধস রোধ ও পানিনিষ্কাশনের জন্যও ছিল অত্যন্ত কার্যকর। এমনকি এখানকার পাথরের দেয়ালগুলি এতটাই নিখুঁতভাবে কাটা যে, একটার ফাঁকে একটি সূচও প্রবেশ করতে পারে না।
বিশ্বাস করা হয়, এখানে এক সময় প্রায় ৮০০ জনের মতো মানুষ বাস করতেন- বিশেষ করে অভিজাত শ্রেণির সদস্য, পুরোহিত ও তাদের সেবকরা। আবহাওয়া অনুযায়ী শীতকালে জনসংখ্যা কমে আসত। খাদ্যতালিকায় ছিল আলু, ভুট্টা, ডাল, মাছ এবং স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা অন্যান্য খাদ্য। এখানকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাণীসম্পদ- লালন-পালন করা হতো লামা, আলপাকা এবং এমনকি গিনিপিগ, যেগুলিকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হতো। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বলছে, এখানে সূর্যের কুমারীরা বা অভিজাত ইনকা নারীদের একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীও বসবাস করতেন।
তবে ইনকা সাম্রাজ্যের এই গৌরব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে স্প্যানিশ বিজয়ীরা দক্ষিণ আমেরিকা দখল করে নেয়। গুটিবসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ইউরোপীয় রোগে অসংখ্য ইনকা মানুষ মারা যায়। ধ্বংস হয় তাদের রাজধানী কুজকো। মাচু পিচু যদিও কোনোভাবে স্প্যানিশদের নজর এড়িয়ে যায়, তবুও একসময় এটি পরিত্যক্ত হয় এবং জঙ্গলে হারিয়ে যায় তার অস্তিত্ব।
বিংহামের আবিষ্কারের পর থেকে এই স্থানটি বিশ্বজুড়ে ইতিহাসপ্রেমী, পর্যটক, প্রত্নতত্ত্ববিদ আর প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এক তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। ২০০৭ সালে মাচু পিচুকে বিশ্বের নতুন সাত আশ্চর্যের একটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইউনেস্কো ১৯৮৩ সালে একে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমানে, সংরক্ষণের স্বার্থে প্রতিদিন মাত্র ২,৫০০ জন পর্যটক এখানে প্রবেশের অনুমতি পান। পেরু সরকারও এখানে বিমানের উড়ান নিষিদ্ধ করেছে, যাতে পরিবেশ ও স্থাপনাগুলির ক্ষতি না হয়।
আজকের দিনে মাচু পিচু শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয়- এটি এক জীবন্ত ইতিহাস। প্রতিটি পাথরে, প্রতিটি সোপানে, প্রতিটি ছায়ায় লুকিয়ে আছে এক রাজ্যের গৌরবগাথা, যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে বিস্মিত করে আসছে। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যখন পর্যটক সূর্যাস্ত দেখে, তখন মনে হয় সময় যেন কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেছে, আর ইতিহাস নিজের কানে গল্প বলছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন