প্রযুক্তির জগতে জাপানে চমকের শেষ নেই। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে দেশটি। এবার এমন এক প্রযুক্তি সামনে এনেছে তারা, যা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করাও কঠিন- ‘হাঁটলেই বিদ্যুৎ তৈরি’!
জাপানের বিভিন্ন ব্যস্ত শহরের ফুটপাতে এমন বিশেষ টাইলস বসানো হয়েছে, যা মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ থেকেই তৈরি করছে বিদ্যুৎ। প্রযুক্তিটির নাম ‘পায়োজোইলেকট্রিক টাইলস’।
ফুটপাত বা রেলস্টেশনের মতো জায়গায় বসানো এই টাইলসগুলোর নিচে থাকে স্প্রিং বা পায়োজোইলেকট্রিক পদার্থ। কেউ হাঁটলেই টাইলসটি সামান্য নিচের দিকে নেমে যায়, আর তখনই তৈরি হয় যান্ত্রিক চাপ। এই চাপ থেকে তৈরি হয় বিদ্যুৎ।
২০০৮ সাল থেকেই জাপান এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষের একটি পদক্ষেপ থেকে ১০ ওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব, আর একসঙ্গে হাজার হাজার মানুষের চলাচলে তৈরি হয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শক্তি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই টেকনোলজি যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে ব্যস্ত কোনো স্টেশন থেকে প্রতিদিন যতটুকু বিদ্যুৎ তৈরি হবে, তা দিয়ে চালানো যাবে শত শত আলো-পাখা।
বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত রেলস্টেশন টোকিওর শিনজুকু স্টেশন- যেখানে প্রতিদিন যাতায়াত করেন প্রায় ৩৮ লাখ যাত্রী। এখানেই পরীক্ষামূলকভাবে বসানো হয় পায়োজোইলেকট্রিক টাইলস। পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিদিন বিপুল মানুষের চলাচলের ফলে তৈরি হয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ।
শুধু রাস্তা বা স্টেশনেই নয়, জাপান সরকার এই টাইলস বসাতে চাইছে শপিং মল, বিমানবন্দর, অফিস ভবন এমনকি স্কুল-কলেজে।
এই প্রযুক্তির ভিত্তি হলো- ১৯ শতকের বিজ্ঞানী কিউরি ভাইয়েরা আবিষ্কৃত পায়োজোইলেকট্রিকের প্রভাব। এই প্রভাব অনুযায়ী, কোয়ার্টজ বা টোপাজের মতো কিছু খনিজ পদার্থে চাপ প্রয়োগ করলে সেখানে তৈরি হয় বিদ্যুৎ। এই একই প্রযুক্তি ব্যবহার হয় লাইটার, ইলেকট্রনিক ঘড়ি, এমনকি সেন্সর তৈরিতে।
তবে এই প্রযুক্তির এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে-
১) উচ্চ খরচ – একটি টাইলস বসাতে খরচ পড়ে ৫০ থেকে ১০০ ডলার।
২) কম বিদ্যুৎ উৎপাদন – প্রতি পদক্ষেপে খুব বেশি শক্তি তৈরি হয় না।
৩) রক্ষণাবেক্ষণ খরচ – ব্যস্ত এলাকায় দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
তবুও গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যস্ত এলাকাগুলোতে এই প্রযুক্তি দীর্ঘমেয়াদে অত্যন্ত কার্যকর। যেমন ২০১৭ সালের এক গবেষণা বলছে, মিসরের এলশোহাদা স্টেশনে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ প্রায় ৯৯.৯৩ শতাংশ কমে যাবে।
বিশ্বের শক্তির ভান্ডার যত দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, ততই প্রয়োজন বিকল্প শক্তির উৎস। জাপানের এই উদ্ভাবন হতে পারে এমন এক সবুজ প্রযুক্তি, যা কার্বনমুক্ত সমাজ গড়তে সাহায্য করবে।
এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ জাপানের এই প্রযুক্তি নিজেদের দেশে আনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উপযুক্ত পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ পেলে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার হতে পারে একটি বাস্তব সম্ভাবনা।