বৃহস্পতিবার, ০১ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: মার্চ ১৮, ২০২৫, ০১:৫৩ এএম

উৎসবের আমেজে জাল নোট চক্র

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: মার্চ ১৮, ২০২৫, ০১:৫৩ এএম

উৎসবের আমেজে জাল নোট চক্র

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঈদসহ বিভিন্ন উৎসব এলেই সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল নোট চক্রের কারবারিরা। নানা কৌশলে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় বিপণিবিতান ও শপিংমলে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এসব নোট। চলতি রমজান মাসে অর্ধশতাধিক চক্র ঈদ বাজারে অন্তত ১০ কোটি জাল নোট ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। 

এমন তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা নজরদারি ও অভিযান শুরু করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। শুধু তাই নয়, কারবারিরা সামাজিক মাধ্যমে নামে-বেনামে বিভিন্ন আইডি বা পেজ খুলে প্রকাশ্যে বিক্রি করছে জাল নোট। ঘরে বসে অনলাইনে অর্ডার করলেই চাহিদামতো মিলে যায় জাল নোট। 

সারা দেশে দেওয়া হয় জাল টাকার হোম ডেলিভারির সুবিধা। অনলাইনে বিজ্ঞাপন হিসেবে জাল টাকা বিক্রি করে কোটিপতি হওয়ার লোভনীয় অফারের ফাঁদও পাতছে বিভিন্ন অদৃশ্য চক্র। ফলে আসন্ন ঈদ ঘিরে জাল টাকা নিয়ন্ত্রণে সাইবার মনিটরিংও জোরদার করেছে গোয়েন্দারা। 

তদন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, রাজধানীর আশপাশ এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে গোপনে জাল নোট তৈরির চক্রে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ইয়াবাসহ মাদক কারবারি, হাসপাতালের দালাল, চোরাকারবারি, গার্মেন্ট ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। কয়েক ধাপে বিক্রি হয় এসব জাল নোট। 

জানা গেছে, উৎপাদকের ১ লাখ টাকা তৈরি করতে খরচ হয় ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা। চক্রটি পাইকারি বিক্রেতার কাছে ১ লাখ জাল নোট বিক্রি করে ১৪-১৫ হাজার টাকায়। পাইকারি বিক্রেতা প্রথম খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে ২০-২৫ হাজার টাকা, প্রথম খুচরা বিক্রেতা দ্বিতীয় খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে ৪০-৫০ হাজার টাকায় এবং দ্বিতীয় খুচরা বিক্রেতা মাঠ পর্যায়ে সেই টাকা আসল ১ লাখ টাকায় বিক্রি করে। 

পুলিশ জানিয়েছে, রমজান ও ঈদ টার্গেট করে বিপুল জাল নোট তৈরি করেছে বেশ কয়েকটি চক্র। এরই মধ্যে একটি চক্র ৪০ থেকে ৫০ লাখ জাল টাকা বাজারে ছেড়েছে। চক্রটির নিজেদের তৈরি করা বি-গ্রেড মানের ১ লাখ টাকার জাল নোট ৯ থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। 

পুলিশের দাবি, জাল নোট কারবারিদের বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করা হলেও কিছুদিন পর জামিনে বেরিয়ে আবার একই অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে তারা। পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জনায়, গত পাঁচ বছরে এই চক্রের চার শতাধিক অপরাধী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। ধরা পড়ার পর জামিনে বের হয়ে ফের একই কাজে যুক্ত হচ্ছে।  

জানা গেছে, গত রবিবার মধ্যরাতে রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৩৮ লাখ ৫২ হাজার ৬০০ জাল নোট ও জাল নোট তৈরির বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত দুজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। 

তাদের কাছ থেকে শুধু বাংলাদেশি জাল টাকাই নয়, বিপুল পরিমাণ ভারতীয় জাল রুপিও জব্দ করা হয়েছে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, এই চক্র দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের দেশি ও বিদেশি জাল নোট তৈরি করে ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করে আসছিল। তারা এবার আসন্ন ঈদ সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ জাল নোট তৈরি করে সেগুলো সরবরাহ করার জন্য জমা করে, কিন্তু অবশেষে তাদের গোয়েন্দা জালে ধরা পড়তে হলো।  

এ বিষয়ে গতকাল সোমবার ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, ওয়ারীতে একটি ভবনের ছয় তলায় জাল নোটের কারবার করে চক্রটি। 

এমন তথ্যের ভিত্তিতে ওই বাড়িতে অভিযান চালায় ডিবি-উত্তরা বিভাগের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক নিয়ন্ত্রণ টিম। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর চেষ্টাকালে জাল নোট ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান ও মেহেদী হাসানকে প্রথমে ধরা হয়। 

এ সময় একজন কৌশলে পালিয়ে যায়। গ্রেপ্তারের সময় তাদের হেফাজত থেকে ১০০০ ও ৫০০ টাকা মূল্যমানের মোট ৩৮ লাখ ৫২ হাজার ৬০০ টাকার জাল নোট, ৭৭ হাজার ১০০ ভারতীয় রুপির জাল নোট, একটি সিপিইউ, একটি মনিটর, জাল নোট তৈরিতে ব্যবহৃত প্রিন্টারের আটটি অব্যবহৃত কালির কৌটা, ১০০ পিস ফয়েল পেপার (সিকিউরিটি ফিতা) ও দুটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ওয়ারী থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা হয়েছে। 

এ ঘটনার এক দিন আগে গত শনিবার ২৯ লাখ টাকার জাল নোট, নোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জামসহ চক্রের অন্যতম হোতা সুমনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, চক্রটিকে নজরদারিতে রাখা হয়। পরে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর ও নারায়ণগঞ্জে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. জসীম উদ্দীন বলেন, এই চক্র আসন্ন ঈদ সামনে রেখে ৪০ লাখ টাকার জাল নোট বাজারে ছেড়েছে। এবার ঈদে বিপুল পরিমাণ জাল নোট তৈরি করে সেগুলো সরবরাহের জন্য তাদের হেফাজতেও রেখেছিল। জাল নোট তৈরি ও বিক্রি করার অপরাধে আসামিদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে।  

একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, জাল চক্রের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা নজরদারি চলমান রয়েছে। তাছাড়া জাল টাকার কারবারিরা এখন অনলাইনেও সক্রিয়। তারা সামাজিক মাধ্যমে নামে-বেনামে বিভিন্ন আইডি ও পেজ খুলে জাল টাকার বিজ্ঞাপন দেয়। পাশাপাশি দেশের যেকোনো প্রান্তে হোম ডেলিভারির সুবিধাও রয়েছে তাদের। 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নানা ধরনের অপরাধী চক্র যেমন সক্রিয় হচ্ছে, তেমনি জাল টাকার কারবারিরাও বসে নেই।  

ডিবি পুলিশের এক কর্মকতা জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে জাল নোট কারবারিরা যে অনলাইন কারবার শুরু করেছে, সে বিষয়ে গোয়েন্দা বিভাগ অবগত রয়েছে, যার কারণে ঈদ ও রমজানকে ঘিরে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। 
তিনি জানান, জাল টাকা তৈরিতে সারা দেশে সক্রিয় ৫০টি চক্রের বেশি। এসব অপরাধীকে ধরতে তৎপর পুলিশ। 

জেল থেকে বের হয়ে আবারও সক্রিয় তারা: পুলিশ জানিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তারকৃত জাল টাকার কারবারিরা জেল থেকে বের হয়েই একই পেশায় সক্রিয় হয়ে যায়, যার কারণে এই চক্রগুলো বাগে আনতে বেগ পোহাতে হচ্ছে। 

জাল টাকার কারবারিদের বিরুদ্ধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা আছে। এদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো সময়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। তিন থেকে ছয় মাসের বেশি কেউ জেল খাটে না। পরে জামিনে বেরিয়ে আবার একই অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে তারা।

জাল টাকা তৈরিতে ব্যবহৃত সরঞ্জাম সংগ্রহের বিষয়ে ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, যে কাগজ ব্যবহার হয়, সেগুলো নীলক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা। অন্যান্য উপাদানের সোর্স বিশেষ করে কেমিক্যাল পুরান ঢাকা থেকে নেয়। 

আর জাল টাকা বাজারে ছড়ানো হয় তিন ধাপে।  প্রতিটি চক্রের রয়েছে ২০ থেকে ২৫ সদস্য। তারা বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কাজ করে। মূল হোতাদের কাছ থেকে তারা ১ লাখ জাল টাকা ১৫ হাজার টাকায় কেনে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জাল নোট তৈরির জন্য প্রথমে টিস্যু কাগজের একপাশে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি স্ক্রিনের নিচে রেখে গাম দিয়ে ছাপ দেয়।  এরপর ১০০০ লেখা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রামের ছাপ দেয়। 

অতঃপর অপর একটি টিস্যুপেপার নিয়ে তার সঙ্গে ফয়েল পেপার থেকে টাকার পরিমাপ অনুযায়ী নিরাপত্তা সুতা কেটে তাতে লাগিয়ে সেই টিস্যু ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবির জলছাপ দেওয়া টিস্যুপেপারের সঙ্গে গাম দিয়ে সংযুক্ত করে দেয়। 

এভাবে টিস্যুপেপার প্রস্তুত করে বিশেষ ডট কালার প্রিন্টারের মাধ্যমে ল্যাপটপে সেভ করে রাখা টাকার ছাপ অনুযায়ী প্রিন্ট করা হয়। ওই টিস্যু পেপারের উভয় সাইট প্রিন্ট করা হয় এবং প্রতিটি টিস্যু পেপারে মোট চারটি জাল টাকার নোট প্রিন্ট করা হয়।

এরপর প্রিন্ট করা টিস্যুপেপারগুলো কাটিং গ্লাসের ওপরে রেখে নিখুঁতভাবে কাটিং করা হয়। পরবর্তীতে কাটিং করা জাল টাকাগুলো বিশেষভাবে বান্ডিল করে এটি চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, যারা জাল টাকা বাজারে ছাড়ে তারা একটি সংঘবদ্ধ চক্র। অতিরিক্ত গোয়েন্দা নজরদারি রাখলেই এই চক্রের হাত থেকে সাধারণ মানুষ রক্ষা পেতে পারে।  এবং টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে সবাই সচেতন হলে অনেকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক জানান, ঈদ বা বড় বড় উৎসবে জাল টাকা প্রস্তুতকারক ও কারবারিদের অপতৎপরতা বেড়ে যায়। এরই মধ্যে বেশ কিছু কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা বাইরে আছে তাদের গ্রেপ্তারের জন্য প্রতিদিনই অভিযান চলমান রয়েছে। পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে, যাতে কেউ জাল নোট বাজারে ছাড়তে না পারে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!