প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের স্বেচ্ছাচারিতায় দিনে দিনে অস্থির হয়ে উঠছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পরিবেশ। মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা ছাড়াই নিজের খেয়াল খুশিমতো সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রশাসকের সাথে ‘সহমত’ না হলেই কর্মকর্তাদের বদলিতে এক অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে ডিএনসিসি প্রশাসনে।
শূন্য পদে প্রেষণে পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তাদের মাঝেও ডিএনসিসিতে যোগদানে অনীহা দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি গাবতলীর পশুর হাট ইজারাসংক্রান্ত মোহাম্মদ এজাজের এক সিদ্ধান্তকে ‘স্বেচ্ছাচারী’ বলছেন ডিএনসিসির একাধিক সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা। প্রশাসকের কথার প্রতিবাদ জানানোতে বদলি হতে হয়েছে বলেও অভিযোগ আরেক কর্মকর্তার। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সবকিছু আইনের মধ্যে থেকেই করছেন বলে দাবি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের।
গত এপ্রিলে রাজধানীর গাবতলী পশুর হাটের ইজারা বাতিল করেন প্রশাসক এজাজ। এর আগে ইজারার দরপত্র আহ্বান করা হলে সর্বোচ্চ করদাতার অনুকূলে কার্যাদেশ জারি করতে দেননি তিনি। সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ বর্তমান নাম বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি বা বিপিপিএ) ওয়েবসাইটে ইজারার দরপত্র প্রকাশ না করার কারণ দেখিয়ে ইজারা বাতিল করে ‘খাস’ আদায়ের সিদ্ধান্ত নেন প্রশাসক। যদিও পাবলিক ক্রয় প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাট ইজারার বিষয়টি সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার মধ্যে না পড়ায়, এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি সিপিটিইউ ওয়েবসাইটে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা নেই।
অভিযোগ উঠেছে, হাটে খাস আদায়ের নামে কার্যত হাসিল আদায় করছেন প্রশাসকের পছন্দের একটি পক্ষ। সেই পক্ষ অর্থাৎ রাইয়ান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সাইদুল ইসলাম ইজারার দরপত্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা ছিলেন। অর্থাৎ সর্বোচ্চ দরদাতাকে বাদ দিয়ে তৃতীয় দরদাতার কাছে হাট তুলে দিয়েছেন প্রশাসক এজাজ। এর বিরোধিতা করে প্রশাসকের চক্ষুশূল হয়ে ডিএনসিসির একাধিক কর্মকর্তাকে বদলি হতে হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ডিএনসিসি প্রশাসক এজাজের বিরুদ্ধে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নেতাদের সুবিধা দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। রাইয়ান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সাইদুল ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং দারুস সালাম থানা বিএনপির আহ্বায়ক এস এ সিদ্দিক ওরফে সাজুর ঘনিষ্ঠ। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় ডিএনসিসির গণশুনানি এবং অন্যান্য কার্যক্রমে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সাথে রাখেন প্রশাসক, নিজের সাথে মঞ্চের আসনেও বসান তাদের।
একই মাসে, রাজধানীর বনানীতে বোরাক টাওয়ার তথা বনানী সুপার মার্কেটের অবৈধ অংশের শেয়ার প্রশাসক এজাজের নেতৃত্বে বুঝে নিয়েছে ডিএনসিসি। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সাথে বনানী সুপার মার্কেট কাম হাউজিং কমপ্লেক্স নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বোরাক রিয়েল এস্টেটের মধ্যে এক অসম চুক্তি হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী, ১৩ তলা ভবনের ৩০ শতাংশ পাবে সিটি করপোরেশন এবং বাকি ৭০ শতাংশ পাবে বোরাক। অবশ্য নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান পরবর্তীতে কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই ভবনটিকে ২৮ তলায় উন্নীত করে। গত ১২ এপ্রিল এই ভবনের ১৪ থেকে ২০ তলা অংশ বুঝে নিতে বোরাকের সাথে চুক্তি করে ডিএনসিসি। প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের উপস্থিতিতে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামান করপোরেশনের পক্ষে এতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তি স্বাক্ষরকালে ডিএনসিসির তৎকালীন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।
চুক্তি স্বাক্ষরের সাথে সংশ্লিষ্ট এক সূত্রের মতে, বোরাকের কার্যালয়ে পৌঁছানোর পূর্বে ডিএনসিসি কর্মকর্তারা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে জানতেনই না। ডিএনসিসির অংশ কীভাবে বুঝে পাওয়া যাবে, এ বিষয়ক সভা হওয়ার কথা ছিল বোরাকের কার্যালয়ে। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েকদিন পূর্বে প্রশাসক এবং প্রধান নির্বাহীসহ করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে এ বিষয়ে এক সভা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, বোরাকের সাথে এই জটিলতা প্রশাসকের উপস্থিতিতেই নিরসন করা হবে। এই সভার কার্যবিবরণী চূড়ান্ত হওয়ার আগেই চুক্তি করে বসেন এজাজ। উপরন্তু, বোরাকের সাথে এই চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে অধিকতর অংশ আদায়ে ডিএনসিসিকে জোর দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন এবং মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্থানীয় সরকার বিভাগ। অথচ মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা পাশ কাটিয়ে মাত্র ৪০ শতাংশ হিসেবেই বোরাকের থেকে শেয়ার বুঝে নেওয়ার চুক্তি করে ডিএনসিসি। এ বিষয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ কামরুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, (বোরাকের সাথে) যে চুক্তি করেছি, সেটা ‘এন্ডোর্সমেন্টে’র জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এটাতে (মন্ত্রণালয়ের) কোনো মতামত থাকলে দিবে, সমস্যা নাই। আমরা মন্ত্রণালয়েরই অংশ। ১৫ বছর ধরে এই সমস্যার সমাধানে অনেকেই চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু হয়নি। আমি দায়িত্ব নিয়ে ১০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা উঠাইছি। মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর সবাই সাধুবাদ জানিয়েছে। কেউ এই চুক্তির বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছে বলে জানি না। তারপরেও যদি দ্বিমত থাকে, নথি পাঠানো আছে। তারা মতামত দিক। সিটি করপোরেশন এবং রাষ্ট্রের উপকারের জন্য নিয়েছি এবং এটা নেওয়া উচিত ছিল।
এদিকে ডিএনসিসির একাধিক সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা জানান, প্রশাসক এজাজের ‘হ্যাঁ’-তে হ্যাঁ আর ‘না’-তে না অর্থাৎ ‘সহমত’ না হলে সেখানে চাকরি করা যায় না। যোগদানের মাত্র চার মাসের মাথায় বদলি হওয়ার রেকর্ডও রয়েছে ডিএনসিসিতে। এমন প্রেক্ষাপটে করপোরেশনের দুই শীর্ষ পদে পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তারা যোগদানে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। গত বছরের ১৭ নভেম্বর ডিএনসিসির প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন কে এম জহুরুল আলম। প্রশাসক এজাজ আহমেদের এক কথার প্রতিবাদ করে মাত্র চার মাসের মাথায় বদলি হতে হয় তাকে। ডিএনসিসির বিভাগীয় প্রধানদের এক সভায় ভান্ডার বিভাগের সব কর্মকর্তাকে ‘করাপ্টেড’ (দুর্নীতিগ্রস্ত) বলেন প্রশাসক এজাজ। এই ঘটনার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, প্রশাসকের এমন মন্তব্যে সেখানেই প্রতিবাদ করেন জহুরুল আলম। এই ঘটনার পর বদলির আদেশ পান তিনি। এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও জহুরুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘কোনো একজনের কথামতো কাজ করতে হলে আমরা সেটা করব না। আইনের বাইরে কাজ করব না, সোজা হিসাব। কেউ আইনের বাইরে কিছু করতে বললে, সেটি করব না।’
গত ১৬ এপ্রিল একত্রে বদলি করা হয় ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান এবং প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানকে। গত ২২ এপ্রিল তাদের একত্রে দায়িত্ব থেকে অবমুক্ত করে ডিএনসিসি। এই দুই কর্মকর্তাই ১২ এপ্রিল বোরাকের সাথে ডিএনসিসির চুক্তি স্বাক্ষরকালে উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগ উঠেছে, বোরাকের সাথে চুক্তির বিষয়ে প্রশাসকের মতের বিরুদ্ধে মতামত দেওয়ায় বদলি হতে হয়েছে এই দুই কর্মকর্তাকে। গত ১০ মার্চ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্টাফ অফিসার আক্তার হোসেন শাহিনকে বদলি করা হয়।
অন্যদিকে গত ১৫ এপ্রিল রাজধানীর প্যারিস রোডে ডিএনসিসির এক উচ্ছেদ অভিযানকালে গণমাধ্যমসংক্রান্ত একটি বিষয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইনের প্রতি ক্ষুব্ধ হন প্রশাসক এজাজ। ডিএনসিসিতে চলমান কানাঘুষা অনুযায়ী, এজন্যই ২৮ এপ্রিল বদলি হতে হয় তাকে। যদিও বিষয়টি অস্বীকার করে মকবুল হোসাইন বলেন, গত অক্টোবরেই আমার বদলির আদেশ হয়েছিল। ডিএনসিসিতে চাকরির মেয়াদ ৩ বছর হওয়াতে, আমাকে চলে যেতেই হতো।
কর্মকর্তাদের অভিযোগের বিষয়ে প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, আইনের কাছে আমার হাত বাঁধা। কেউ ভিন্ন কিছু বলে থাকলে ব্যক্তিগত অপছন্দের কারণে বলেছেন। কাউকে বদলি করার আমি কেউ না। এটা জনপ্রশাসন (মন্ত্রণালয়) থেকে করে। আমার কিছু করার নাই। তারা সবাই আমার কর্মকর্তা। আমি যেভাবে নগরকে দর্শন করব, ওনাদের দায়িত্ব হচ্ছে সেটাকে আইনসিদ্ধ উপায়ে দ্রুততার সাথে বাস্তবায়ন করবেন। যেটা আইনসিদ্ধ না, সেটা আমাকে বলবে, প্রয়োজনে লিখিত দেবেন। একটা টিমে টিম লিডার যেভাবে চান, বাকিরা আইনসিদ্ধভাবে সেটার বাস্তবায়ন করেন। আমার কাজে গতি বেশি এবং বেশি কাজ করি। অনেকে এখানে বয়স্ক আছেন। এটা বাস্তবতা যে, কাজের গতি ধরে রাখার সাথে বয়স, সক্ষমতা জড়িত। সেটা একটা বিষয় হতে পারে। তবে আমি খুব গণতান্ত্রিক মানসিকতার মানুষ। গাছ লাগাব, সেটাও গণশুনানি করছি, পরিবেশবাদী সংগঠনদের আনতেছি। সবাই কী বলে সেটা শুনে কাজ করছি।’