গত আট বছরে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও আলোর মুখ দেখেনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। তবে প্রত্যাবাসন থেমে থাকলেও জাতিসংঘের সহায়তায় কিছু রোহিঙ্গাকে তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১১টি দেশে পুনর্বাসিত হয়েছে প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা। তবে এই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ রোহিঙ্গা শরণার্থীরাই।
তাদের দাবি, এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে বাধাগ্রস্ত করছে। একই মত জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ৫ হাজার ৫২০ জন, পরিবার রয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ২৭৪টি। এদের মধ্যে ৫২ শতাংশ শিশু, ৪৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ও ৪ শতাংশ বয়স্ক। পুরুষ ৪৯ শতাংশ, নারী ৫১ শতাংশ। প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে ক্যাম্পে।
অতীতের অনুপ্রবেশ ও প্রত্যাবাসন পরিসংখ্যান- ১৯৭৭-৭৮ সালে অনুপ্রবেশ করে ২ লাখ রোহিঙ্গা, ফিরেছে ১ লাখ ৯০ হাজার। ১৯৯১ সালে আসে ২ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন, ফিরে যায় ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন। ২০১২-১৬ পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করে ৮৭ হাজার। ২০১৭ সালে ৮ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে।
সর্বশেষ ২০২৪-২৫ সালে নতুন করে আশ্রয় নেয় আরও ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে এখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশ সরকার কয়েক দফায় তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারের অনাগ্রহ এবং নিরাপত্তাহীনতা এর প্রধান কারণ।
এ অবস্থায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মধ্যস্থতায় শুরু হয় তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। ২০১৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রক্রিয়ায় ১১টি দেশে মাত্র ৫ হাজার রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তবে এতে সন্তুষ্ট নয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
লম্বাশিয়া ক্যাম্পে ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরে যেতে চান। রোহিঙ্গা নারী শাহনাজ বিবি বলেন, ‘আমরা নিপীড়িত এক জাতি। আমাদের শেষ ভরসা শিক্ষিত রোহিঙ্গারা। কিন্তু তারাও পুনর্বাসনের নামে বিদেশে চলে যাচ্ছে। এতে আমাদের অধিকার আদায়ের কণ্ঠস্বর কমে যাচ্ছে।’
রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ সাদেক ও হুমায়ুন বলেন, ‘যাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে, তারা প্রায় সবাই শিক্ষিত। এতে ক্যাম্পে নেতৃত্ব সংকট তৈরি হচ্ছে।’
রোহিঙ্গা রিয়াজ বলেন, ‘তৃতীয় দেশে গেলে আমাদের স্বাধীনতা আসবে না, বরং সেটা দাসত্বের নতুন রূপ হবে।’
তরুণ আরফাজ কামাল বলেন, ‘আমাদের ঘরবাড়ি মিয়ানমারেই। শরণার্থী হয়ে থাকতে চাই না, ফিরে যেতে চাই নিজের দেশে। লন্ডন, আমেরিকা আমাদের দেশ নয়।’
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘গত ৮ বছরে মাত্র ৫ হাজার রোহিঙ্গা তৃতীয় দেশে পুনর্বাসিত হয়েছে, অথচ একই সময়ে জন্ম নিয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি শিশু। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে একমাত্র পথ হচ্ছে প্রত্যাবাসন।’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান জানান, ‘তৃতীয় দেশে যাওয়ার প্রবণতা শিক্ষিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশি, এতে দেশে ফেরার আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
সম্প্রতি মিয়ানমারের জান্তা সরকার ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার সম্মতি জানালেও, একই সময় রাখাইন রাজ্য থেকে নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে আরও ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ছে।
রোহিঙ্গারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তারা তৃতীয় দেশে নয়, ফিরতে চান নিজ জন্মভূমি মিয়ানমারে। এখন প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর হস্তক্ষেপ ও চাপ, যাতে নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে মিয়ানমার সরকার তাদের ফিরিয়ে নেয়।
আপনার মতামত লিখুন :