প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে রাজধানী ছাড়ছে অসংখ্য মানুষ। শুক্রবার (৬ জুন) দিবাগত রাতেও থামেনি সেই স্রোত। তবে দীর্ঘ যানজটে ক্লান্ত-শ্রান্ত যাত্রীদের চোখেমুখে ঈদের আনন্দের চেয়ে বেশি ছিল উদ্বেগ,দুশ্চিন্তা আর বিরক্তির ছাপ।
শুক্রবার রাত ১টার দিকে ময়মনসিংহ নগরীর মাসকান্দা বাইপাস ঘুরে দেখা যায়, নানা বয়সের মানুষ নারী-পুরুষ, শিশু থেকে গার্মেন্টস শ্রমিক পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বাস কিংবা সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছে। কেউ কেউ ক্লান্ত হয়ে ফুটপাথে বসে পড়েছে, কেউবা নিজের ব্যাগ মাথায় রেখে শুয়ে পড়েছে।
এসময় ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে মোড়ে মোড়ে টহলরত অবস্থায় দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। এর মধ্যে রয়েছেন সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও এপিবিএনের সদস্যরা।
ঘরমুখো যাত্রীরা জানান, এবারের ঈদযাত্রায় অসহনীয় যানজট ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় মানুষের আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে। ঢাকার মহাখালী ও গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ছেড়ে আসা বাসসহ অন্য যানবাহনের ময়মনসিংহ পৌঁছতে সময় লেগেছে ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা। এতে গলদঘর্ম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যাত্রীদের।
ভাওয়াল মির্জাপুর কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. মোস্তাকিম বলেন, ‘দুপুর ২টায় গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে বাসে উঠলেও রাত ১টায় পৌঁছেছেন ময়মনসিংহ বাইপাসে। ৫০০ টাকা ভাড়া দিলেও তিনি পৌঁছেছেন মাত্র বাইপাস পর্যন্ত। গন্তব্য হালুয়াঘাট যেতে আরও কয়েকশ টাকা লাগবে বলে জানান। তার সহযাত্রী শাহরিয়া আহমেদ বলেন, “কীভাবে এসেছি বলে বোঝাতে পারব না। এমন ঈদযাত্রা যেন আর না হয়।’
গাজীপুর কোনাবাড়ী এলাকার একটি শোরুমের কর্মচারী মো. শাহরিয়া আহমেদ বলেন, ‘কীভাবে এসেছি বলে বোঝাতে পারব না। এমন ঈদযাত্রা যেন আর না হয়। পাঁচশ টাকা ভাড়ায় অর্ধেক রাস্তা আসছি। আরও তিনশ করে লাগবে হালুয়াঘাট যেতে। বাস না পেয়ে ৮শ থেকে ১ হাজার টাকা ভাড়ায় সিএনজিতে করে মানুষ ময়মনসিংহ আসছেন বলেও জানান তিনি।’
এই দুই যাত্রী জানান, রাস্তায় প্রচুর লোক। গাড়িগুলোতে অতিরিক্ত ভাড়া। কোনো তদারকি নেই। কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, বেশির ভাগ গার্মেন্টস আজ (বৃহস্পতিবার) ছুটি হয়েছে। তাই অনেক মানুষ আজ বাড়ি ফিরছে।
মহাখালী থেকে শেরপুরগামী গার্মেন্টসকর্মী বেদেনা আক্তার জানান, ‘জনপ্রতি ৭০০ টাকা ভাড়ায় বাসে উঠে ময়মনসিংহ এসে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। শেরপুর যেতে এখন আরও ৫০০ টাকা করে ভাড়া দাবি করছে চালকরা। তিনি বলেন, আমি তেজগাঁওয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করি। আজই ছুটি পেয়েছি। আমার মতো অসংখ্য শ্রমিক আজ বেতন হাতে পেয়ে রওনা দিয়েছেন বাড়ির পথে। কিন্তু রাস্তায় পড়ে আছি। বাসে জায়গা নেই, সিএনজিতে ভাড়া চাচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত।’
রাতভর বাইপাস এলাকায় গ্যাস পাম্পসংলগ্ন জায়গায় হিজড়াদের চাঁদাবাজির দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন যাত্রীরা। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, টাকা না দিলে তারা যাত্রীদের ব্যাগ ও মানিব্যাগ টেনে নিচ্ছেন। এমন সময় অনেক যাত্রী হতবিহ্বল অবস্থায় দ্রুত বাস বা সিএনজিতে উঠে গন্তব্যে রওনা দিচ্ছেন।
যাত্রীদের অভিযোগ, রাস্তায় কোনো ভাড়া তদারকির ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাড়তি ভাড়া আদায়ের পর কেউ কোনো প্রশ্ন তুললে চালকরা যাত্রীকে মাঝপথেই নামিয়ে দিচ্ছেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জানাচ্ছেন, তারা চেষ্টা করছেন যাত্রীদের নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন যাত্রা নিশ্চিত করতে, তবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ঘটনা প্রশাসনিক নজরদারির অভাবেই ঘটছে।
একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান ঢাকার আশুলিয়ায় গার্মেন্টস চাকরি করা হালুয়াঘাট দক্ষিণ মনিকুড়া এলাকার যুবক খাইরুল ইসলামসহ আরও অনেকেই। এসময় তারাকান্দা থেকে নগরীর বাইপাস আসা মো. জসীম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি জানান, একই অবস্থা নগরীর পাটগুদাম ব্রিজ এলাকার। যাত্রীর চাপে ব্রিজ থেকে যানজট ছড়িয়ে পড়েছে শম্ভুগঞ্জ মোড় পর্যন্ত।
এদিকে পথে পথে ভোগান্তির পাশাপাশি রাতভর ময়মনসিংহ বাইপাস গ্যাস পাম্পের সামনে হিজড়াদের চাঁদাবাজি উৎপাতে ব্যাপক নাজেহাল হওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেক যাত্রী। এসময় টাকা না দিলে যাত্রীদের মানিব্যাগ টানাটানি করাও অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।
একই সময়ে বাস, ট্রাক, সিএনজি, মাহেন্দ্র ও পিকআপে চড়ে ভোগান্তির শিকার হয়ে বাড়ি ফিরতে দেখা গেছে অনেক যাত্রীকে। তবে বাইপাস এলাকায় সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে কোনো যানবাহনকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে যানজট সৃষ্টি করতে দেখা যায়নি। এসময় একের পর এক যাত্রীবাহী যান ছুটতে দেখা গেছে শেরপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইলের সড়কগুলোতে।
নগরীর বাইসপাস এলাকায় আলোর স্বল্পতায় আলো আবছা অন্ধকার ছিল দৃশ্যমান। সড়কের বেশির ভাগ লাইটগুলো জ্বলছে না। আলোর স্বল্পতার কথা জানিয়ে বাইপাসে কর্মরত ধোবাউড়া থানার পুলিশ সদস্য মো. টিপু সুলতান বলেন, সড়কের বেশিরভাগ লাইট নষ্ট। ঈদযাত্রায় লাইটগুলো জ্বললে ভালো হতো।
সেখানে কর্মরত সেনা সদস্যরা জানান, ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭০ জন্য সদস্য ও কর্মকর্তা নগরীর কয়েকটি পয়েন্টে কাজ করছে। অনেক স্থানে যানবাহনগুলোতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়েরও ঘটনা ঘটছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি কোনো ধরনের হয়রানি ছাড়া মানুষের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে।
তবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ঘটনা নজরদারিতে দায়িত্বশীল কাউকে দেখা যায়নি বলেও জানান একাধিক পুলিশ সদস্য ও ভুক্তভোগী যাত্রীরা। অন্যদিকে, সড়কের নিরাপত্তায় এপিবিএন ও র্যাব সদস্যদের যানজট এড়াতে টহল দিতে দেখা গেছে।
ময়মনসিংহ বাইপাসে উপস্থিত ময়মনসিংহ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সোহরোয়ার্দী সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “পথে পথে ভোগান্তি থাকুক আমার কী? এখানে তো যানজট নেই।” দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার এমন মন্তব্যে হতাশ যাত্রীরা প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে প্রশাসন আসলে কী করছে?
ঈদের এই আনন্দযাত্রায় গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই বিপর্যস্ত হচ্ছে লাখো মানুষের ঈদ। অতিরিক্ত ভাড়া, যানজট, অব্যবস্থাপনা আর নিরাপত্তার ঘাটতি মিলিয়ে যেন ঘরমুখো মানুষের এ যাত্রা পরিণত হয়েছে এক কঠিন পরীক্ষায়।