ঢাকা শুক্রবার, ১৩ জুন, ২০২৫

বিদেশগামী শ্রমিকদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ‘টিকিট সিন্ডিকেট’ 

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: জুন ১২, ২০২৫, ০৬:১৪ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

টিকিট বিক্রির নামে এয়ারলাইন্স এজেন্সিকে ব্যবহার করে বিদেশগামী শ্রমিকদের পকেট কেটে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। শুধু টিকিট নয়, মেডিকেল টেস্টের নামেও প্রতারণা করে এজেন্সিগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা। বিদেশগামী শ্রমিক ও একাধিক ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
 
এ বিষয়ে গোয়েন্দা সূত্র বলছে, এখনো ফ্যাসিস্ট সিন্ডিকেটের দখলে বিমানের টিকিট। এই সিন্ডিকেট যাত্রীদের জিম্মি করে দুই থেকে তিনগুণ দামে টিকিট বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ছাড়া বেসামরিক বিমান চলাচল পর্যটন মন্ত্রণালয় তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রেও এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) এ বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, কোনো এজেন্সির এসবের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের চিরতরে ট্রেড থেকে বিতাড়িত করা হবে। তাদের জায়গা অ্যাসোসিয়েশনে হবে না।

একাধিক বিদেশগামী শ্রমিক ও ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশকিছু শ্রমিককে বিমানের টিকিট দেওয়ার নামে ট্রাভেল এজেন্টদের কাজে লাগিয়ে এয়ারলাইন্সগুলোকে প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে বিদেশগামীদের সর্বশান্ত করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টিকিট বিক্রির নামে শ্রমিকের পকেট কাটার এই সিন্ডিকেটের প্রধান হোতা গ্যালাক্সি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ। পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের গোপন অংশীদারও এই ওয়ালিদ। ওয়ালিদ ফ্যাসিস্টদের দোসর ও বড় অর্থদাতা। গত ১৭ বছরে প্রায় ৮টি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের জিএসএ এককভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন তিনি। এ ছাড়া এই সিন্ডিকেটে ১১টি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স, তাদের জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) এবং অন্তত ৩০টি ট্রাভেল এজেন্সির জড়িত থাকার খবর জানা গেছে।

সাত বছর আগে কাজের সন্ধানে সৌদি আরবে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার ছেলে মোখলেছুর রহমান (৩৫)। তৃতীয়বার দেশে এসে কোম্পানির ডাকে তড়িঘড়ি তাকে ফিরতে হয়েছে তার কর্মস্থলে। এ সময় নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে টিকিট নিতে হয়েছে তাকে। এ বিষয়ে তিনি বলেন এগুলো এখন কমন। আমাদের বলা হয় টিকিটের দাম বাড়তি। আমাদের যেতে হবে, তাই কোনো উপায় থাকে না।

কাতার প্রবাসী মোশারফ হোসেন বলেন, আমি দুই তিন মাস পরপর দেশে আসি। যাওয়ার সময় প্রায়ই আমাকে বাড়তি টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। টিকিটের মূল্যের বিষয়ে জানতে চাইলে নানা কথা শোনা যায়।

দুবাই প্রবাসী তানভীর হাসান বলেন, আপনি হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন বিদেশে যাবেন বা আপনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যেতে চাইছেন, সেটা যদি ওরা বুঝতে পারে তাহলে আপনার কাছে বাড়তি টাকা দাবি করবে। এ ছাড়া টিকিট কাটতে এসে আমরা প্রায়ই ‘আসন ফাঁকা নেই’, ‘অপেক্ষা করতে হবে’ এসব কথা শুনি। জরুরিভিত্তিতে টিকিট  কাটলে একটাই উপায় বাড়তি টাকা দিতে হবে। এটা একটা সিন্ডিকেট ছাড়া আর কিছু না।

এদিকে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক তদন্তেও সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার তথ্য ওঠে এসেছে। মন্ত্রণালয়ের তদন্তে কেলেকঙ্কারির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্ত প্রতিবেদন ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্টদের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। তদন্তে ১১টি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স, তাদের জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) এবং অন্তত ৩০টি ট্রাভেল এজেন্সি সিন্ডিকেটে জড়িত বলে ওঠে এসেছে। আর এই সিন্ডিকেটের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় রয়েছেন আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ। প্রতিবেদনে তাকে বলা হয়েছে টিকিট  সিন্ডিকেটের মূলহোতা। ইতিমধ্যে কমপক্ষে এক ডজন ট্রাভেল এজেন্সিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়ে তলব করেছে মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের গঠিত ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিএসএ হিসেবে সৌদিয়া, কাতার এয়ারওয়েজ, সালাম এয়ার, জাজিরা এয়ারওয়েজ, ওমান এয়ার এবং থাই এয়ারওয়েজের টিকিটের একক নিয়ন্ত্রণ নেন ওয়ালিদ। তার প্রতিষ্ঠান (গ্যালাক্সি ইন্টারন্যাশনাল) যাত্রীদের নাম ছাড়াই গ্রুপ বুকিংয়ের মাধ্যমে টিকিট মজুত করে। পরে সেগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দ্বিগুণ বা তিনগুণ দামে বিক্রি করে। এতে করে ৫০ হাজার টাকার টিকিট  এক থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে।

অন্যদিকে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নির্ধারিত ৭ শতাংশ কমিশনের বাইরে বাড়তি দাম নির্ধারণ করে টিকিট  বাজার ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক মুনাফা করেছে। এমনকি কিছু প্রতিষ্ঠান সাব-এজেন্টদের মাধ্যমে ‘ব্লক টিকিট’ বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে চক্র গঠন করে টিকিট সিন্ডিকেট কারসাজি করে যাচ্ছে।
 
এজেন্সিগুলোর মধ্যে রয়েছে- কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, সিটিকম ইন্টারন্যাশনাল, কিং এয়ার এভিয়েশন, আরবিসি ইন্টারন্যাশনাল, মেগা ইন্টারন্যাশনাল, মাদার লাভ এয়ার ট্রাভেলস, জেএস ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস, সাদিয়া ট্রাভেলস, হাশেম এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, নারিয়া ট্রাভেলস, এলহাম করপোরেশন এবং আল গাজী।

অন্যদিকে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বড় অঙ্কের কর ফাঁকির অভিযোগে গ্যালাক্সি ইন্টারন্যাশনালের ওয়ালিদ ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তাদের প্রতিষ্ঠান ইডিএস শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিদেশি মদ বাজারজাত করছে বলেও তদন্তে উঠে এসেছে। করমুক্ত সুবিধার আড়ালে চালানো এই কর্মকাণ্ডে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর থেকে কয়েক দফায় অভিযান চালানো হয়েছে।

এ বিষয়ে কর কমিশনার মো. আব্দুর রকিব বলেন, যারা কর ফাঁকি দিয়েছে এবং বাজার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকার টিকিট দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা নজিরবিহীন প্রতারণা ও শ্রমিকদের রক্ত শোষণ করা।

এদিকে এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে পেরে ওঠছে না দাবি করে আটাব সূত্র জানিয়েছে, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর থাকায় আটাবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে আটাব সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ জানান, এয়ার টিকিট  সিন্ডিকেটকারীদের ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা অভিযোগ তুলে ধরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। টিকিট  সিন্ডিকেটের এসব সদস্যদের ট্রেড থেকে বিতারিত করতে হবে। যারা বিদেশগামী শ্রমিকদের টিকিট বিক্রির নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে তাদের চিহ্নিত করতে পারলে সংগঠন থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অভিযোগের বিষয়ে গ্যালাক্সি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদের মোবাইল নম্বরে কল করলে তার স্টাফ অফিসার (এক্সিকিউটিভ) মোস্তফা আহমেদ রুবেল রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের পরিচালকের সঙ্গে এখন কথা বলা যাবে না। তিনি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না।

এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু লাভের কথা না ভেবে জনসেবার দিকটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখে এয়ারলাইন্সগুলোকে দায়িত্বশীল হতে হবে। তবে তার পরও কারসাজির মূল হোতাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় আগামীতেও বিদেশগামী শ্রমিকদের ভোগান্তিতে পড়বে হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।