যান্ত্রিক জীবনের কোলাহলে মাঝেমধ্যে এমন রাগ চাপে, মনে হয় হাতের কাছে থাকা মুঠোফোন, টেলিভিশন, প্লেট বা গ্লাস সবকিছু ভেঙে ফেলি! এই অনুভূতি নিশ্চয়ই নতুন কিছু নয়। জীবনের নানা সময়ে আমরা সবাই এমন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাই, যখন মনে হয় ভাঙচুর করলে বুঝি রাগটা একটু কমত। কিন্তু চারপাশের বাস্তবতা তো আর আমাদের সেই সুযোগ দেয় না। পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক মূল্যবোধ, আইনগত বাধা কিংবা নিজের বিবেক; সবকিছু মিলিয়ে আমরা রাগটা বুকের ভেতর জমিয়ে রাখি। অথচ ঠিক এই রাগ, হতাশা আর মানসিক চাপে ডুবেই অনেকে হারিয়ে ফেলেন স্বস্তির জীবন। এসব কিছু মাথায় রেখেই ঢাকার ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোডে চালু হয়েছে দেশের প্রথম ‘রেইজ হাউস’ বিনোদনকেন্দ্র, যেখানে আপনি ইচ্ছামতো যত খুশি ভাঙতে পারবেন। টাকার বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একা বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন বিশেষভাবে তৈরি একটি ঘরে। সেখানে রাখা থাকবে ভাঙার জন্য নানারকম জিনিস। পুরোনো টেলিভিশন, মনিটর, কম্পিউটার কী-বোর্ড, মাউস, কাচের বোতল, মাটির তৈরি তৈজসপত্র ইত্যাদি। আপনি চাইলে লাঠি, হাতুড়ি বা ব্যাট দিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে দিতে পারেন যতক্ষণ না আপনার রাগ বা আবেগ হালকা হয়। শুরুতে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন প্যাকেজ রয়েছে এখানে। প্রতিটি প্যাকেজে নির্দিষ্টসংখ্যক ভাঙার উপকরণ, নির্ধারিত সময়, এবং প্রটেকশন গিয়ার দেওয়া হয়। যার মধ্যে থাকে গ্লাভস, হেলমেট, ফেস শিল্ড ও বডি প্রটেকশন স্যুট। এই পুরো অভিজ্ঞতাটিকে আরও আবেগতাড়িত করে তুলতে রেইজ রুমগুলো সাজানো হয়েছে রহস্যময় আলো-আঁধারিতে। দেয়ালে আঁকা হয়েছে স্প্রে পেইন্ট আর গ্রাফিতি, চালানো হয় থ্রিলিং মিউজিক বা আপনার নিজের পছন্দের প্লেলিস্ট। কেউ চাইলে একা, আবার কেউ চাইলে দল বেঁধেও অংশ নিতে পারেন এই ভাঙচুর-থেরাপিতে। এখানে এসে অনেকেই বলেন, প্রথম কয়েক মিনিট ভাঙতে একটু দ্বিধা লাগে, কিন্তু একবার শুরু করলে যেন অন্য এক জগতে ঢুকে পড়েন তারা। কেউ কেউ তো আবার আবেগে কেঁদেও ফেলেন। বাইরের দেশে রেইজ রুম অনেক পুরোনো এবং জনপ্রিয় একটি কনসেপ্ট। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, থাইল্যান্ড, এমনকি ভারতের বড় শহরগুলোতেও রয়েছে এমন কেন্দ্র। বাংলাদেশে এবারই প্রথম কোনো উদ্যোক্তা সাহস করে এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন। বিষয়টি অনেকের কাছে প্রথমে হাস্যকর বা অর্থহীন মনে হতে পারে। কেউ কেউ ভাবতে পারেন ‘ভাঙলে কী আর হবে?’ কিন্তু যারা একবার এসেছেন, তারা বলছেন, এটা নিছক একটা ভিন্নধর্মী বিনোদন নয়, বরং একধরনের মানসিক প্রশান্তি। যেমন কেউ জিমে গিয়ে শরীরচর্চা করেন, কেউ পাহাড়ে গিয়ে চিৎকার দেন, কেউ গান শোনেন ঠিক তেমনি কেউ কেউ এই ভাঙচুর-ক্রিয়াকে নিজের আবেগ প্রকাশের উপায় হিসেবে নিচ্ছেন। এটা কোনো চিকিৎসা নয়, তবে একটা প্রাথমিক মানসিক ‘ভেন্টিং’ পদ্ধতি হিসেবে কাজে দিতে পারে। রেইজ হাউসের এই অভিজ্ঞতা শুধু তরুণদের নয়, মধ্যবয়সি এমনকি বয়স্কদের জন্যও হতে পারে এক নতুন রকম মানসিক চর্চা। মানসিক চাপ, হতাশা বা দুঃখের মতো অনুভূতিগুলোকে অনেকেই লজ্জার বিষয় বলে চেপে রাখেন। কিন্তু এগুলোর প্রকাশ প্রয়োজন, এবং তা যদি হয় নিরাপদ উপায়ে তাহলে তো কথাই নেই। কেউ কেউ এখানে এসে ভাঙার পর থেমে যান, কেউ আবার পরের সপ্তাহেই ফেরেন আরও বড় প্যাকেজে। কেউ কেউ ভিডিও করেন, ইনস্টাগ্রামে শেয়ার দেন, কেউ আবার ফিরে গিয়ে নিজেকে নতুনভাবে চিনতে শেখেন। সবশেষে এটুকুই বলা যায়, শহরের কোলাহল, কাজের চাপে ক্লান্ত মুখ আর ভেতরে জমে থাকা রাগ-হতাশার জন্য এই রেইজ হাউস হতে পারে এক ছোট্ট স্বস্তির ঠিকানা। আপনি হাসতে পারেন, কাঁদতে পারেন, চিৎকার করতে পারেন। আর হ্যাঁ, নিশ্চিন্তে ভাঙতেও পারেন। তবে দুর্ঘটনার ও ঝুঁকি এড়াতে সতর্কতার বিকল্প নেই।
আপনার মতামত লিখুন :