ঢাকা শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

১০০ শতাংশ নিরাপদ পানি পেতে বাংলাদেশের আরও কত বছর লাগবে

বিশেষ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৫, ১২:৪২ পিএম
সবার জন্য নিরাপদ পানি। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে পানি ও স্যানিটেশন খাতে নানা ধরনের অগ্রগতি অর্জন করেছে। খোলা স্থানে মলত্যাগের হার প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনা, গ্রামীণ এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপন এবং শহরে ওয়াসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে পানির প্রাপ্যতা বাড়ানো- এসব ক্ষেত্রে অর্জন স্পষ্ট। ২০০০ থেকে ২০১৫ জাতিসংঘের তৈরি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) সময়ে বাংলাদেশ প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষের জন্য খাবার পানি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এখানে একটি বড় ফাঁক রয়ে যায়- সবার জন্য পানি থাকলেও সেই পানি কতটা নিরাপদ, সেটি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ে।

জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) যৌথ মনিটরিং প্রোগ্রাম ((জেএমপি)-এর ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে মাত্র ৫৯ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে। ২০১৫ সালে এ হার ছিল ৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় এক দশকে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। এই ধারা অব্যাহত থাকলে সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে আরও অন্তত ৭৫ বছর সময় লাগবে।

নিরাপদ পানি বনাম সাধারণ পানি

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- সবার জন্য পানি আর সবার জন্য নিরাপদ পানি এক নয়। এমডিজির সময়ে বাংলাদেশ সাধারণ পানির প্রাপ্যতায় সাফল্য দেখিয়েছে, কিন্তু নিরাপদ পানি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে খুবই সীমিত অগ্রগতি হয়েছে।

নিরাপদ পানি বলতে বোঝায়- এমন পানি যা বাড়ির ভেতরে বা নিকটস্থ উৎস থেকে সহজে পাওয়া যায়, প্রয়োজনের সময় সর্বদা পাওয়া যায়, এবং মলজাতীয় জীবাণু ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থেকে মুক্ত থাকে।

বাংলাদেশে পানির বড় সমস্যা হলো মান নিয়ন্ত্রণ। অনেক এলাকায় পানিতেই-কোলাইয়ের মতো মলজাতীয় জীবাণু পাওয়া যায়। একই সঙ্গে আর্সেনিক দূষণ এখনো ৬০টিরও বেশি জেলায় বিরাজ করছে। গ্রামে অনেক মানুষ নলকূপের পানি ব্যবহার করলেও তার একটি বড় অংশ আর্সেনিক দূষিত। শহরে ওয়াসার মাধ্যমে পানির সরবরাহ থাকলেও সেই পানি প্রায়ই পানযোগ্য নয়।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের অবস্থাকে আরও স্পষ্ট করে বুঝতে হলে প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে তাকাতে হবে। এক দশকে নিরাপদ পানির প্রাপ্তি ভারতে ৬১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৬ শতাংশ। ‘স্বচ্ছ ভারত’ কর্মসূচি এবং রাজনৈতিক অগ্রাধিকার এই অগ্রগতির প্রধান কারণ। ভুটানে ২০১৫ সালে নিরাপদ পানির আওতায় ছিল ৪৭ শতাংশ মানুষ, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৬৬ শতাংশ। পাকিস্তানে মাত্র ৪৫ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে, এক দশকে অগ্রগতি মাত্র ১ শতাংশ। নেপাল সবচেয়ে পিছিয়ে, যেখানে মাত্র ১৬ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও ভারত ও ভুটানের তুলনায় অনেক পিছিয়ে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

বিশ্বজুড়ে এখনো পানীয় জলের বড় সংকট রয়ে গেছে। ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ৯৬১ মিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানির আওতায় এসেছে। তবুও বিশ্বে ২.১ বিলিয়ন মানুষ এখনো নিরাপদ পানি পাচ্ছে না। শহরে কভারেজ তুলনামূলক বেশি হলেও গ্রামীণ এলাকায় এখনো অর্ধেকের বেশি মানুষ নিরাপদ পানি বঞ্চিত।

স্যানিটেশনের ক্ষেত্রেও বৈশ্বিক চিত্র উদ্বেগজনক। বর্তমানে ৩.৪ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিশ্বজুড়ে খোলা স্থানে মলত্যাগকারীর সংখ্যা কমলেও এখনো প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ এ অভ্যাস বজায় রেখেছে। স্বাস্থ্যবিধির ক্ষেত্রেও বৈশ্বিকভাবে বড় ফাঁক রয়ে গেছে। প্রায় ১.৭ বিলিয়ন মানুষ মৌলিক হাত ধোয়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

বাংলাদেশের স্যানিটেশন চিত্র

বাংলাদেশ খোলা স্থানে মলত্যাগ প্রায় বন্ধ করতে সক্ষম হলেও স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। বর্তমানে প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ ন্যূনতম স্যানিটেশন সুবিধা পাচ্ছে না। এছাড়া ২ কোটি মানুষ হাত ধোয়ার মৌলিক সুবিধা ছাড়াই বসবাস করছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অগ্রগতি অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশে সর্বজনীন স্যানিটেশন নিশ্চিত হতে ২০৮৩ সালের আগে সম্ভব নয়। তুলনায় ভারত ২০৪১ সালের মধ্যে এবং নেপাল ২০৪৯ সালের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা রাখে।

সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে নিরাপদ পানির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মান নিয়ন্ত্রণ। পানিতে আর্সেনিক, আয়রন, ই-কোলাই জীবাণু ও শিল্পবর্জ্য দূষণ একটি বড় সমস্যা হয়ে আছে। শহরাঞ্চলে ওয়াসার পানি প্রায়ই পানযোগ্য নয়, পাইপলাইনের দূষণও সমস্যা তৈরি করে। গ্রামীণ এলাকায় আর্সেনিক ও লবণাক্ততা- বিশেষত দক্ষিণাঞ্চলে- গুরুতর সংকট।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের অভাব। ভারত ও ভুটানের মতো বাংলাদেশে এখনো নিরাপদ পানি রাজনৈতিক এজেন্ডায় অগ্রাধিকার পায়নি। এছাড়া পানি পরিশোধন, স্যানিটেশন অবকাঠামো ও মান পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন নেই।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি-৬)

এসডিজি ৬–এর লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না, যদি না এখনই জরুরি ভিত্তিতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পানি ও স্যানিটেশন খাতকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোর সমান গুরুত্ব দিতে হবে।