এ পর্যন্ত তিনবার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের। তৃতীয় দফার বর্ধিত মেয়াদও প্রায় শেষের দিকে। আগামী ৩১ অক্টোবর কমিশনের তৃতীয় মেয়াদের বর্ধিত সময় শেষ হবে। এখনো ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাস্তবায়ন পদ্ধতির সুপারিশ চূড়ান্ত করতে পারেনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
গতকাল শনিবারও এ নিয়ে নির্ধারিত আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা ও নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছেন কমিশনের সদস্যরা। তবে বাস্তবায়ন পদ্ধতির সুপারিশ চূড়ান্ত হয়নি। আজ রোববার (২৬ অক্টোবর) ফের বৈঠক করবে।
জানা গেছে, আদেশের নাম ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ-২০২৫’ চূড়ান্ত হলেও গণভোটের সময় ও সংবিধান সংস্কারের জন্য আগামী সংসদের ভূমিকা এবং এই কাজের মেয়াদকাল বেঁধে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।
এদিকে গতকাল সকালে জাতীয় সংসদ ভবনে কমিশনের কার্যালয়ে কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতিনিধি দল। তারা কমিশনকে জানিয়েছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের কপি দেখে সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
গতকাল বিকেলে আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করেছে কমিশন। বৈঠক শেষে কমিশন জানায়, সভায় সনদ বাস্তবায়নের নানা সুপারিশ নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আগের দিনের অসমাপ্ত আলোচনার ধারাবাহিকতায় আজকের অধিবেশন সম্পন্ন হয়। কমিশন আশাবাদ ব্যক্ত করেছে যে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ সুপারিশপত্র খুব শিগগিরই সরকারের কাছে জমা দেওয়া যাবে।
সূত্র জানিয়েছে, আলোচনায় যেসব বিষয় ঠিক হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ-২০২৫’ আদেশ জারির পর একটি অধ্যাদেশ জারি করে গণভোট করা হবে। সেখানে সংস্কারের জন্য আদেশের সঙ্গে শর্তজুড়ে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে পরবর্তী সংসদকে সংবিধান সংস্কারের জন্য ৯ মাস সময় বেঁধে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এই সময় সংসদ একই সঙ্গে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। তবে বিষয়টি নিয়ে বেশকিছু প্রশ্নও সামনে চলে আসছে। এসব বিষয় নিয়েই মূলত গতকাল শনিবারও আলোচনা করা হয়। বিশেষ করে সংবিধান সংস্কার পরিষদের জন্য জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কীভাবে বাধ্যতামূলক করা যায় এ বিষয়ে পথ খোঁজা হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করার পক্ষে মত দিয়েছে।
গতকাল সকালে জাতীয় সংসদের এলডি হলে এনসিপির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার ও ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দার। এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার, জাবেদ রাসিন ও খালেদ সাইফুল্লাহ এবং যুগ্ম সদস্যসচিব জহিরুল ইসলাম মুসা।
বৈঠক শেষে আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদের যতটুকু অর্জন সেটাকেও যদি পরিপূর্ণভাবে আমরা বাস্তবায়ন করতে চাই, তা হলে অবশ্যই এই বাস্তবায়নের পথরেখা জাতির কাছে পরিষ্কার করতে হবে। এ জন্য সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া জাতির কাছে উপস্থাপন করতে হবে। কমিশন যে আন্তরিকতার জায়গা থেকে এই বাস্তবায়ন আদেশ প্রণয়নে কাজ করছে, সেটাকে আমরা সাধুবাদ জানিয়েছি। কিন্তু সেটা যেন কোনোভাবে জুলাই ঘোষণাপত্রের মতো কোনো দলের চাপে পড়ে একটা কাগজে দলিল হিসেবে উপস্থাপিত না হয়, সে ব্যাপারে আমরা খেয়াল রাখার আহ্বান জানিয়েছি।
জুলাই সনদের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঐকমত্য হওয়া অনেক বিষয় আড়ালের চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেন আখতার হোসেন। তিনি বলেন, আইনি ভিত্তি পরিষ্কার না করেই সরকার ও ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছে। তাই আমরা গত ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদ স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছি। আমরা মনে করি, জুলাই সনদ স্বাক্ষর শুধু আনুষ্ঠানিকতা। বাস্তবায়ন ব্যতিরেকে সনদ স্বাক্ষরিত হলে আমরা যতটুকু অর্জন করতে চেয়েছিলাম, তা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। সে কারণে সনদ স্বাক্ষরকেই আমরা মূল বিষয়বস্তু মনে করি না। আমরা বাস্তবায়ন আদেশের বিষয়ে একটি পরিষ্কার বার্তা জনগণের কাছে উপস্থাপন করে জুলাই সনদকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছি।
জানা গেছে, জুলাই সনদে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো নোট অব ডিসেন্টসহ একমত হলেও সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি ভিন্নমতে অনড়। আইনি ভিত্তি প্রশ্নে গণভোটের সিদ্ধান্তে একমত হলেও গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে সনদের সঙ্গে পৃথক সুপারিশ আকারে সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি সংক্রান্ত প্রস্তাব সরকারকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায় কমিশন। কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে সংস্কার প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া ৩০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৫টি দল স্বাক্ষর করলেও ৫টি দল স্বাক্ষর করেনি। কমিশনের পক্ষ থেকে ওই ৫ দলের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

