ঢাকা রবিবার, ০২ নভেম্বর, ২০২৫

আলু কেনার ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়নে নেই সরকার

জুবায়ের দুখু
প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০২৫, ১০:৩৭ এএম
আলু চাষি। ছবি - সংগৃহীত

সরকার ২২ টাকা কেজি দরে কৃষকের লোকসান কমাতে প্রায় ৫০ হাজার টন আলু কেনার ঘোষণা দিয়েছিল। চলতি বছরের ২৭ আগস্ট এই ঘোষণা দিলেও গত দুই মাসে তা বাস্তবায়ন হয়নি। এতে করে হিমাগার ও বাজারে ওঠা আলুর দাম নিয়ে হাহাকার করছে কৃষকরা।

জানা গেছে, এখন পাইকারি বাজারে আলুর কেজি কেনাবেচা হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকায়, যা খুচরায় ১৫ থেকে ২০ টাকা। মাসখানেক আগেও এর দাম ছিল ২৫ টাকা। অথচ গত বছরের একই সময়ে প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা। ফলে গত বছরের তুলনায় এ বছর পণ্যটির দাম কমেছে প্রায় ৬৩ শতাংশ।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানায়, এবার চাহিদার চেয়ে প্রায় ৪০ লাখ টন বেশি উৎপাদন হওয়ায় সরবরাহের স্রোতে বাজারে এমন দরপতন হয়েছে।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন জানায়, এখনো হিমাগারে আলু পড়ে আছে। বিক্রির জন্য হাতে আর বেশি সময় নেই। হিমাগারে প্রতি কেজি আলুর দাম এখন ১০ থেকে ১২ টাকা, যা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০–১২ টাকা কম বা অর্ধেক।

সংস্থাটি আরও জানায়, আলু ক্রয়ের সরকারি ঘোষণা কার্যকর না হওয়ায় কৃষকরা টিকে থাকতে পারছেন না। তাদের দাবি, সরকার দ্রুত ঘোষিত ৫০ হাজার টন আলু কেনার কার্যক্রম শুরু করুক, নয়তো আগামী মৌসুমে অনেকেই আলু চাষ থেকে সরে যাবেন।

হিমাগার মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৪০ হিমাগারে এখনো প্রায় ২০ লাখ টন আলু বিক্রি হয়নি। হিমাগারে আলুর দাম নেমে এসেছে কেজিপ্রতি ৯ থেকে ১১ টাকায়। এতে উৎপাদন খরচই ওঠানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ কৃষকদের।

তাদের অভিযোগ, সরকার ২২ টাকা কেজি দাম বেঁধে দেওয়ার পর থেকেই প্রতি কেজি আলুর দাম এখন ১০ থেকে ১২ টাকায় নেমেছে, যা ঘোষণার আগে পাইকারিতে বিক্রি হতো ১৬ থেকে ১৭ টাকায়।

এ পরিস্থিতিতে কৃষকদের ক্ষতি কমাতে দ্রুত সরকারি ক্রয় কার্যক্রম শুরুর দাবি জানিয়েছে হিমাগার মালিক সমিতি। পাশাপাশি আগামী মৌসুমে চাষিদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা।

এদিকে কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে আলু উৎপাদিত হয়েছিল ৯ লাখ ৩৮ হাজার ৮২৪ মেট্রিক টন, যা ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ১০ লাখ ৩০ হাজার ৫১৭ মেট্রিক টন। অর্থাৎ গত বছরে আলুর উৎপাদন বেড়েছে ৯১ হাজার ৬৯৩ মেট্রিক টন। একই সময় দেশের অন্যান্য জেলাতেও চাহিদার তুলনায় আলু উৎপাদন বেশি হয়েছে। এটিই আলুর দাম কমার মূল কারণ।

বিশ্লেষকদের মতে, আলুর এমন দরপতনে দেশের কৃষকেরা হতাশ হচ্ছেন। ঘোষণা অনুযায়ী সরকারের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা উচিত। কারণ, কৃষকরা লাভের আশায় এবার বেশি জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। দ্রুত কৃষকদের পাশে না দাঁড়ালে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন।

জয়পুরহাটের কৃষক ও হিমাগার মালিকদের ভাষ্যমতে, আলুর দাম যখন কমে গিয়েছিল, তখন সরকার ২২ টাকা কেজি দরে আলু কেনার কথা বলেছিল এবং একটি মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এক কেজিও আলু ক্রয় করা হয়নি।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার আলু চাষি মোজাম্মেল হক টুটুল বলেন, ‘১৬৪ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। উৎপাদন হয়েছে ৯ হাজার ৩৪৮ বস্তা আলু। মোট খরচ করেছি ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। সরকারের আলু কেনার ঘোষণার অপেক্ষায় বিক্রি বন্ধ রেখেছি। কিন্তু তাতেও সুবিধা হয়নি। দাম না ওঠায় এখনো ২ হাজার বস্তা আলু হিমাগারে ফেলে রেখেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার বলেছিল আলু কিনবে, কিন্তু এখন পর্যন্ত এক বস্তাও কেনেনি। ভেবেছিলাম সরকার কিনবে, তাহলে ক্ষতিটা একটু কমবে। এখন লোকসানে ডুবে আছি। কোল্ড স্টোরেজের খরচ দিয়ে এখন আলু তুলতেও পারছি না। সরকারের উচিত আমাদের দিকে নজর দেওয়া।’

এদিকে চাষিদের প্রাণে আশা ফেরাতে অনুরোধ জানিয়েছে হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। গত আগস্টে তারা কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠায়।

চিঠিতে বলা হয়, এবার আলুর দরপতন হওয়ায় আগামী মৌসুমে অধিকাংশ কৃষক চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশকসহ অন্যান্য খরচের সংস্থান করতে পারবেন না। তাই দেশের চাহিদামতো প্রায় ৯০ লাখ টন আলু উৎপাদন করতে হলে অক্টোবরের মধ্যেই আলুচাষিদের প্রণোদনা দেওয়া জরুরি।

তবে কী ধরনের প্রণোদনা প্রত্যাশা করা হচ্ছে, সে বিষয়ে বিসিএসএ প্রেরিত ওই চিঠিতে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির সভাপতি বলেন, গত আগস্টে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এ বিষয়ক প্রজ্ঞাপনে কী ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। চাষিরা যেহেতু লোকসানে পড়েছেন, তাই তারা আর্থিক প্রণোদনাই চান।

চিঠিতে শঙ্কা প্রকাশ করে হিমাগার মালিকরা বলেন, যদি সরকার ঘোষিত প্রণোদনা পেতে দেরি হয়, তবে অনেক কৃষক নিরুপায় হয়ে হিমাগারে সংরক্ষিত তাদের প্রায় ৯ লাখ টন আলুবীজ খাবার আলু হিসেবে বিক্রি করে দিতে পারেন। এতে দেশে চাহিদামতো আলু উৎপাদন নাও হতে পারে। ফলে গত বছরের মতো আবারও আলুর কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকায় ঠেকতে পারে।