ঢাকা শুক্রবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৫

৮ মাত্রায় ভূমিকম্প হলে ঢাকার পরিস্থিতি হবে মৃত্যুপুরী

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২৫, ০২:২৯ পিএম
ছবিটি এআই দিয়ে বানানো।

রিখটার স্কেলে সাত মাত্রা বা তার বেশি ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। শহরের অধিকাংশ ভবনই ধসে পড়বে।

বিশেষ করে গিঞ্জি পরিবেশ থাকায় উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটবে। এমনটাই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০.৩৮ মিনিটের দিকে রাজধানীসহ সারাদেশে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এই ভূমিকম্পে সারাদেশে যেমন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এবং এখন পর্যন্ত প্রায় ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

বেশ কিছু ভবন হেলে পড়াসহ একটি ভবন ধসের খবরও পাওয়া গেছে। এই খবরে রাজধানীর রাস্তায় জনসাধারণের ভীড় দেখা গেছে। এখন পর্যন্ত সারাদেশে ৩ শতাধিক হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।

ঘন ঘন ভূমিকম্পের কারণে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ভূগৌলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে ৮ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কারণ তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশ। একাধিক ফল্টও রয়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশকে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

আর বাংলাদেশের মাটির নীচে যে পরিমাণ শক্তি জমা আছে, তাতে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে অনেকে বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এ ধরণের ভূমিকম্প হলে ঢাকার পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, হতে পারে এক মৃত্যু নগরী।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার অদূরে টাঙ্গাইলের মধুপুরে মাটির নিচে যে ফল্টলাইন রয়েছে, সেখানে রিখটার স্কেলে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ‘ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে’।

অন্যদিকে সিলেটের ডাউকি চ্যুতিরেখায় ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার কমপক্ষে ৪০,৯৩৫টি ভবন ধসে পড়বে বলেও ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে।

বুয়েটের এক তথ্যানুযায়ী, রাজধানীতে মোট ভবন আছে ২১ লাখ। এর মধ্যে ৬ লাখ ভবন ছয়তলা বা তার চেয়ে উঁচু। তবে সবশেষ কত ভবন তৈরি হয়েছে তা জানা যায়নি।

যদিও রাজউক সূত্র জানায়, নগরীর ২২ লাখ ভবন রয়েছে। তবে এগুলো অধিকাংশই একতলা।

এছাড়া রাজউকের একাধিক জরিপ বলছে, রাজধানীর দুই-তৃতীয়াংশ ভবন বা প্রায় ৭৫ শতাংশ ভবনই নিয়ম মেনে তৈরি হয়নি। অর্থাৎ ওই ভবনগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে।

শুধু ভবন ধসে পড়াই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় মাটির নিচ দিয়ে সেবা সংস্থাগুলোর (গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ) বিভিন্ন লাইন গেছে। ভূমিকম্পের ফলে কোনো ভবন ধসে পড়লে সেসব সেবা লাইন উপড়ে যাবে। আর সেগুলো তখন জনজীবনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

এদিকে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকির কথা জানিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স।

জানা যায়, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ এবং ঢাকা অঞ্চল ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

এই অবস্থায় ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য সব পর্যায়ে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড–২০২০ অনুযায়ী, ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ করা, ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো ভবনগুলোর সংস্কার ও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, সব বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা, ইউটিলিটি সার্ভিস যেমন- গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইনের সঠিকতা নিশ্চিত করা—সহ বেশ কিছু সতর্কতা দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন ভূঁঞা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকার ভূত্বক ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। ভূগর্ভস্থ পানি আস্তে আস্তে নিচে চলে যাচ্ছে। ফলে ভূমিকম্প ছাড়াই একসময় ভবন ধসে পড়বে।’

‘আর মাঝারি ধরণের ভূমিকম্প আঘাত আনলেই ঢাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। অপরিকল্পিত নগরায়নে যে গিঞ্জি পরিবেশ তৈরি হয়েছে, উদ্ধার প্রক্রিয়াও জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ আটকে পড়েই মারা যাবেন। তাই ভূমিকম্পের আগাম প্রস্তুতি নেওয়া খুবই জরুরি’, যোগ করেন ভূতত্ত্ববিদ।

অনেকটা একই রকম কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্প গবেষক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার।

তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘যেভাবে ঢাকা শহরের মাটির ভূগঠন পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে ভূমিকম্প ছাড়াই বিল্ডিং হেলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই এলাকায় (বাংলাদেশে) বড় ভূমিকম্প হয়েছে বহু বছর আগে। অন্তত ৮০০ থেকে হাজার বছর আগে। এরপর থেকেই আবার শক্তি জমা হচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ে যে পরিমাণ শক্তি জমা হয়েছে, তা বেরিয়ে এলে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। আর সেটি ঘটলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা।’