ঢাকা সোমবার, ০৪ আগস্ট, ২০২৫

বিলুপ্তির পথে লাকসামের ঐতিহ্যবাহী তেলের কল

লাকসাম (কুমিল্লা) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০২৫, ১১:৩৭ এএম
লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজারের ঐতিহ্যবাহী তেলকল– এখন কেবলই অতীতের সাক্ষ্য। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী বাজার ‘দৌলতগঞ্জ’। ‘দৌলত’ ও ‘গঞ্জ’ শব্দের সমন্বয়ে গঠিত এ বাজার একসময় ধন-সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। বিশেষ করে এখানকার তেলকল দীর্ঘ সময় ধরে স্থানীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে, নানা প্রতিকূলতায় একসময়কার গর্বিত এ শিল্প আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।

এক সময় দৌলতগঞ্জ বাজারজুড়ে ছিল প্রায় ৩৬টি তেলকল। বর্তমানে সচল রয়েছে মাত্র ৫-৬টি। এর মধ্যে রয়েছে মেসার্স বাবুল অয়েল মিল, দি নিউ ইউনাইটেড অয়েল মিল, কোহিনুর অয়েল মিল, ন্যাশনাল অয়েল মিল ও পুতুল অয়েল মিল। মিলগুলোতে আগে দিনরাত উৎপাদন চললেও এখন চলছে অপ্রতিযোগিতামূলক, লোকসানকেন্দ্রিক আংশিক কার্যক্রম।

বিলুপ্তির পেছনে কারণ

১. মোটা অংকের করের বোঝা: সরকারিভাবে বিভিন্ন দপ্তর থেকে ৮-১০টি লাইসেন্স ও নিয়মিত নবায়ন করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ ব্যয় গুনতে হচ্ছে মিল মালিকদের। বছরের শেষে জমা দিতে হয় মোটা অংকের কর, যা লোকসানি ব্যবসার জন্য বড় বোঝা।

২. ভেজাল তেলের দাপট: কম দামের ভেজাল সয়াবিন ও পাম অয়েল বাজার দখল করে নিয়েছে। অধিক মুনাফার লোভে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মানহীন ও ক্ষতিকর তেল বিক্রিতে আগ্রহী, যার ফলে খাঁটি সরিষার তেলের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।

৩. সরিষা আমদানিতে সিন্ডিকেট ও জটিলতা: সরিষা উৎপাদন কমে যাওয়া ও আমদানিতে সিন্ডিকেট কারসাজি, কাগজপত্রে জটিলতা এবং উচ্চমূল্য– সবকিছু মিলিয়ে মিল মালিকরা বিপাকে পড়ছেন।

৪. চাহিদা কমে যাওয়া ও নামমাত্র ব্যবহার: একসময় রান্নার অপরিহার্য উপাদান ছিল সরিষার তেল। এখন কেবল ভর্তা, সালাদ কিংবা ত্বকের যত্নে সীমিত ব্যবহারেই খাঁটি তেল ব্যবহৃত হচ্ছে। এই চাহিদা-হ্রাসই মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

৫. অভিজ্ঞ শ্রমিক সংকট: এক সময়কার অভিজ্ঞ মিস্ত্রিরা নিজ এলাকায় ছোট কল বসিয়ে অবৈধভাবে তেল উৎপাদনে যুক্ত হয়েছেন। এতে মূল মিলগুলোর বিক্রি কমেছে এবং শ্রমিক সংকট প্রকট হয়েছে।

৬. খৈল বিক্রির সংকট: সরিষা খৈল একসময় মাছচাষ, পানের বরজ ও কৃষিকাজে ব্যাপক ব্যবহৃত হতো। এখন এসব ক্ষেত্রেও ব্যবহার কমে যাওয়ায় খৈলের বিক্রি নেই বললেই চলে।

‘ছাইড়া দে মা, কাইন্দা বাঁচি’

বর্তমানে সচল থাকা মিলগুলো চলছে কেবল পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষার দায়বদ্ধতায়। লাভ তো দূরের কথা, মালিকরা বলছেন- বছরের শেষে লোকসান হিসেব করেও সরকারকে কর দিতে হয়। অনেকেই নিজের মিল মালিক পরিচয় দিতেও অনীহা প্রকাশ করছেন।

মেসার্স জুবলি অয়েল মিলের মালিক সিরাজুল হক বলেন, ‘একসময় ৩৬টি মিল দিনরাত সচল থাকলেও এখন ৫-৬টি কেবল টিকে আছে। দোকানিরা অধিক লাভের আশায় ভেজাল তেল বিক্রি করছেন। সরকারের কঠোর নীতিমালা, লাইসেন্স জটিলতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ, আমদানি সিন্ডিকেট- সব মিলিয়ে আমরা আর পারছি না। মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই আমরাও হারিয়ে যাব।’

বাবুল অয়েল মিলের মালিক ছায়ীদুর রহমান বাবুল বলেন, ‘শ্রমিকরা এখন নিজেরাই গ্রামে ছোট কল বসিয়ে ব্যবসা করছে, খৈলের বিক্রি নেই, সরিষার দামও চড়া- সব মিলিয়ে আমাদের ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যাচ্ছে।’

হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য 

তেলকল একসময় শুধু পেশা নয়, গর্বের প্রতীক ছিল। পূর্বপুরুষের পেশাগত এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে আজকের প্রজন্ম আগ্রহ হারাচ্ছে। সরকারি সহায়তা, নীতিগত সংস্কার এবং স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোগ না থাকলে লাকসামের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প অচিরেই হারিয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়।