কয়েক সপ্তাহ ধরে মালির নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হচ্ছে এবং রাজধানী বামাকোকে কেন্দ্র করে এক গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আল-কায়েদার সহযোগী জামা’আ নুসরাত আল-ইসলাম ওয়াল-মুসলিমিন (জেএনআইএম) নতুন কৌশল গ্রহণ করে শহরের আশেপাশে গুরুত্বপূর্ণ রুট নিয়ন্ত্রণ করছে এবং বামাকোর সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের সংযোগকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। দেশের প্রধান সড়কগুলো এখন বিপজ্জনক, অনেক সময় অচল হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে জ্বালানি কনভয়গুলোর ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ রাজধানীতে প্রায় অবরোধ সৃষ্টি করেছে, এর ফলে বাজারে খাদ্য, জ্বালানি এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে।
সরকারি সেবা ভেঙে পড়ছে
আর্থিক অনিশ্চয়তা, বকেয়া বেতন এবং চরম নিরাপত্তাহীনতার কারণে সরকারি কর্মচারী, বিশেষ করে- শিক্ষকরা তাদের কর্মস্থল ছেড়ে যাচ্ছেন। কিছু অঞ্চলে স্কুল খোলাই যাচ্ছে না। মালির রাষ্ট্রযন্ত্র যেভাবে ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ছে, তাতে প্রশ্ন উঠেছে- শুধু জেএনআইএম-এর হামলা নয়, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অবক্ষয়ই কি মালির মূল বিপর্যয়?
এক্ষেত্রে প্রকৃত প্রশ্ন হলো- আর্থিকভাবে বিচ্ছিন্ন একটি শাসনব্যবস্থা কতদিন টিকে থাকতে পারবে?
‘জেএনআইএম’ কি বামাকো দখল করবে?
বিশ্লেষকদের মতে, জেএনআইএম-এর সরাসরি বামাকো দখলের সম্ভাবনা কম। কারণ: ১) রাজধানী আক্রমণের মতো লজিস্টিক সক্ষমতা তাদের নেই। ২) জেএনআইএম কোনো একক সংগঠন নয়- এটি উত্তর ও মধ্য মালির বিভিন্ন স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর জোট, যাদের উদ্দেশ্যও এক নয়। ৩) সংগঠনের অভ্যন্তরে চাপা দ্বন্দ্ব এবং পরিবর্তনশীল আনুগত্য বড় ধরনের সামরিক অভিযান বাধাগ্রস্ত করে।
তবে তাদের নতুন কৌশল- সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ, চেকপোস্ট বসানো, জ্বালানি আটকে রাখা- রাজধানীর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে এবং শাসনব্যবস্থাকে অচল করতে পারছে। এই বাস্তবতাই বামাকোর সত্যিকারের দুর্বলতা।
ফরাসির বিদায়ে পরিস্থিতি খারাপ?
অনেকেই মনে করেন ফরাসিরা চলে যাওয়ার পর মালির পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তবে বাস্তবতা আরও জটিল। অপারেশন সার্ভাল (২০১৩) এবং বারখানে (২০১৪–২০২২) দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা আনতে ব্যর্থই ছিল। বিপরীতে, এই দীর্ঘ যুদ্ধই ফরাসি বাহিনীকে দেশে অপ্রিয় করে তোলে এবং ২০২২ সালে তারা প্রত্যাহার করে।
মালির নতুন সামরিক সরকার ফরাসি-বিরোধী অবস্থানকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলেও, শাসনব্যবস্থা যে উপনিবেশীকরণের অবশিষ্ট কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে, তা উপেক্ষা করা যায় না। ফরাসি অভিযান শুধুই সামরিক ব্যর্থতা নয়—ফরাসি ও মালির বাহিনীর মধ্যকার সম্পর্কেও গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছিল, যা এখনো মালির জনমনে বিরাজমান।
ফরাসিরা চলে যাওয়ার পর সরকার রাশিয়ার সহযোগিতা নেওয়া শুরু করে। ওয়াগনার গোষ্ঠী এবং বর্তমানে ‘আফ্রিকা কর্পস’ নামে পরিচিত কাঠামো মালিতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর ফলাফল এখনো স্পষ্ট নয়।
খেলাফত গঠনের আশঙ্কা?
মালিতে একটি পূর্ণাঙ্গ খেলাফত প্রতিষ্ঠার ধারণা এখনো অত্যন্ত দূরবর্তী। কারণ- ১) মালির সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অনেকেই ‘জিহাদি’ লেবেল পেলেও, তাদের উদ্দেশ্য ধর্মীয় নয়- দারিদ্র্য, বঞ্চনা, স্থানীয় সংঘাত ও প্রতিশোধ তাদের মূল চালিকা শক্তি। ২) জেএনআইএম কোনো ঐক্যবদ্ধ, সুসংবদ্ধ খেলাফত প্রকল্প অনুসরণ করে না। ৩) আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট দুটি আলাদা কাঠামো- তাদের লক্ষ্যও ভিন্ন।
তবে বাস্তব বিপদ হল রাষ্ট্রক্ষমতার খণ্ডিত হয়ে যাওয়া, বৃহৎ অংশে স্থানীয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, এবং সীমান্তজুড়ে রাজনৈতিক ভূগোল পরিবর্তনের সম্ভাবনা।
জ্বালানি অবরোধ
সেপ্টেম্বরের শুরুতে ‘জেএনআইএম’ সিকাসো অঞ্চলে আইভরি কোস্ট থেকে আসা জ্বালানি ট্যাঙ্কারের ওপর হামলা শুরু করে। এই কারণে গত ২৬ অক্টোবর থেকে স্কুল বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় মালির শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, জার্মানি- সব দেশই তাদের নাগরিকদের ‘মালি ত্যাগের’ জন্য সতর্কবার্তা দিতে শুরু করে।
কিন্তু এই আতঙ্কের মধ্যেই বামাকোতে নতুন লিথিয়াম খনি উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি আসিমি গোইতা। এটি মালিকে আফ্রিকার শীর্ষ লিথিয়াম উৎপাদক দেশের কাতারে তুলে আনতে পারে- এটি মালির রাজনৈতিক বার্তা যে তারা এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে।
৫ নভেম্বর সরকার সশস্ত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধানে শত শত জ্বালানি বহনকারী ট্রাক বামাকোতে প্রবেশ করায়। এতে রাজধানীর সরবরাহ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। সরকারের বক্তব্য- অবরোধ আংশিক হলেও রাষ্ট্র তা মোকাবিলা করতে সক্ষম এবং প্রতিদিন শত শত ট্রাক শহরে প্রবেশ করছে।
যদিও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এখনো ‘অবরোধ অব্যাহত’, ‘জিহাদিরা রাজধানী দখলের হুমকি দিচ্ছে’ ধরনের খবর ছড়ানো হচ্ছে, সরকার বলছে- এই আতঙ্ক সৃষ্টিকারী প্রচারণা বাস্তবতাকে অতিরঞ্জিত করছে।
জ্বালানি সরবরাহ পুনরুদ্ধারের কিছুদিন পরই সরকার রাজধানীতে ছয়টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে জেলা হাসপাতালে উন্নীত করার প্রকল্প ঘোষণা করে। পাশাপাশি বোগৌনি, বান্দিয়াগারা ও নিওরোসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে নতুন হাসপাতাল নির্মাণ শুরু হয়- যেসব অঞ্চলে সাম্প্রতিককালে হামলা হয়েছে।
প্রক্সি যুদ্ধের অভিযোগ
মালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুলায়ে ডিওপ সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন যে ‘জেএনআইএম’ স্রেফ স্থানীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নয়- এটি একটি বৃহত্তর প্রক্সি যুদ্ধের অংশ, যাতে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা রয়েছে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, কিভাবে এই গোষ্ঠীগুলো উন্নত ড্রোন পায়, অস্ত্র পায়- যেখানে সাধারণ মানুষ খাবার কিনতেও পারে না।
মালি, বুরকিনা ফাসো এবং নাইজার- এই তিন দেশ এটিকে ‘পরনির্ভরতা ভাঙার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া’ বলে বর্ণনা করছে। তারা দাবি করছে, পশ্চিমা শক্তি এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করছে।
রাষ্ট্র কি টিকে থাকবে?
বামাকোর ওপর চাপ, জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন, সরকারি সেবা বিপর্যস্ত হওয়া- এসব সত্ত্বেও মালি এখনো টিকে আছে। কারণ- ১) মালির সমাজ রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতেও টিকে থাকার নতুন উপায় তৈরি করছে। ২) জেএনআইএম-এর সামরিক সক্ষমতা এখনো রাজধানী দখলের পর্যায়ে পৌঁছেনি। ৩) সরকার কিছুটা হলেও সরবরাহ ও প্রশাসন সচল রাখতে পেরেছে।
তবে মালির প্রকৃত বিপদ হলো দীর্ঘস্থায়ী খণ্ডিত শাসনব্যবস্থা, বিভক্ত ভূখণ্ড এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্র ভেঙে পড়েনি, কিন্তু দমবন্ধ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
বর্তমান পরিস্থিতি
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানিয়েছে, মালির সামরিক বাহিনী ও মিত্র মিলিশিয়ারা চলতি বছরের অক্টোবর মাসে দেশের মধ্যবর্তী সেগো অঞ্চলের দুটি গ্রামে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৩১ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। এই হামলায় কয়েকটি বাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম হামলাটি ২ অক্টোবর কামোনা গ্রামে সংঘটিত হয়, যেখানে সেনাবাহিনী এবং ডোজো মিলিশিয়ারা কমপক্ষে ২১ জন পুরুষকে হত্যা করে এবং ১০টির বেশি বাড়ি ভস্মীভূত করে। দ্বিতীয় হামলাটি ১৩ অক্টোবর বালে গ্রামে ঘটে, যেখানে একজন মহিলা সহ ১০ জন নিহত হন।

