ঢাকা শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৫

পার্বত্য চট্টগ্রামে কার শাসন চলে?

এ এইচ এম ফারুক
প্রকাশিত: নভেম্বর ২২, ২০২৫, ০৮:২৯ পিএম
এ এইচ এম ফারুক । ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলটি প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা কাঠামোর দিক থেকে দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় ব্যতিক্রম। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সহ বিভিন্ন উপজাতীয় সংগঠন অভিযোগ করে আসছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যত সেনা শাসন চলছে। অন্যদিকে, প্রকৃত পক্ষে বাস্তব প্রশাসনিক কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সারা দেশের ৬১ জেলায় সরকারে প্রতিনিধি হিসেবে উন্নয়নসহ সব কার্যক্রম পরিচালনা করে জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন অধিদপ্তর এবং দপ্তর। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে তার ব্যতিক্রম। কীভাবে তা এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করা হল।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:

১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠে। এই দাবিতে ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং ১৯৭৩ সালে সংগঠনেটির সশস্ত্র শাখা কথিত শান্তিবাহিনী গঠন হয়। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।

এক পর্যায়ে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (কথিত শান্তি চুক্তি)। এটি পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।

চুক্তির আওতায় গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ১ টি শক্তিশালি (ভারতের অঙ্গরাজ্যের আদলে) আঞ্চলিক পরিষদ, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু বিষয়ক টাস্কফোর্স  এবং ৩ জেলায় ৩ টি সায়ত্ত্বশাসিত পার্বত্য জেলা পরিষদ। 

জনসংখ্যার হিসাব:

২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) মোট জনসংখ্যা ছিল ১৮,৪২,৮১৫ জন। তবে ধারণা করা হচ্ছে এ জনসংখ্যা এখন ২০ লাখেরমত। যা দেশের ১১.১৯ শতাংশ আয়তনের মধ্যে ১.১৬ শতাংশ মানুষের বসবাস। জনশুমারির হিসাব মতে এর মধ্যে: উপজাতি মোট: ৯,২০,২১৭ জন (৪৯.৯৪) শতাংশ এবং বাঙালি ৫০.০৬ শতাংশ তথা ৯,২২,৫৯৮ জন। এর মধ্যে আবার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আলাদা হিসেবে বাঙালি ৫০.০৬ শতাংশ, চাকমা ২৪.৬৮শতাংশ, মারমা ১১.৩৮শতাংশ, ত্রিপুরা ৭.২৩ শতাংশ, বম, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খিয়াং, লুসাই, পাংখো এবং অন্যান্য মিলে ৬.৬৫ শতাংশ। 

এই তথ্য অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ও উপজাতি জনসংখ্যা প্রায় সমান, তবে বাঙালিদের সংখ্যা সামান্য বেশি। চাকমা সম্প্রদায় উপজাতিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় গোষ্ঠী, এরপর মারমা ও ত্রিপুরা।

প্রশাসনিক কাঠামো: ব্যতিক্রমী বাস্তবতা:

বাংলাদেশের ৬১ জেলায় জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন দপ্তর সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা- রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- এই কাঠামো থেকে ব্যতিক্রম।

পার্বত্য জেলা পরিষদ:

প্রতিটি জেলায় রয়েছে একটি সায়ত্ত্বশাসিত পার্বত্য জেলা পরিষদ, যারা নিচের বিভাগগুলোর নিয়োগ, পদায়ন ও সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, বন বিভাগ, সমাজসেবা, যুব উন্নয়ন, মহিলা বিষয়ক, এলজিইডি বা স্থানীয় সরকার, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, পল্লী উন্নয়নসহ প্রকৌশল ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন অধিদপ্তরগুলো।  

পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বাধ্যতামূলকভাবে একজন উপজাতি। এছাড়াও ৬৭–৭৫ শতাংশ সদস্য উপজাতি। পরিষদগুলো প্রায় তিন যুগ ধরে বিনা নির্বাচনে পরিচালিত হচ্ছে। 

পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়:

পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সরাসরি বাজেট বরাদ্দ, উন্নয়ন প্রকল্প ও নীতিনির্ধারণ করে। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা উপদেষ্টা বাধ্যতামূলকভাবে একজন উপজাতি।

আঞ্চলিক পরিষদ ও সন্তু লারমা:

রয়েছে একটি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, যার চেয়ারম্যান পদে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা রয়েছে জ্যতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। তিনি টানা ২৮ বছর ধরে বিনা নির্বাচনে এই পদে রয়েছেন।

শরনার্থী ও উদ্বাস্তু বিষয়ক টাস্কফোর্স:

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হলো ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরনার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন। এই লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে একটি টাস্কফোর্স, যার নেতৃত্বে থাকেন একজন প্রতিমন্ত্রী (বা কখনো সিনিয়র সচিব) মর্যাদার চেয়ারম্যান। এই চেয়ারম্যানও বাধ্যতামূলকভাবে একজন উপজাতি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড:

পার্বত্য অঞ্চলের অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও অন্যান্য খাতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড।  এই বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে প্রতিমন্ত্রী (বা কখনো কখনো সচিব বা সিনিয়র সচিব) মর্যাদায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একজন উপজাতি নিয়োগ দেওয়া হয়।

৩ সার্কেল চিফ, হেডম্যান ও কার্বারী ব্যবস্থা:

স্থানীয়দের কাছে কথিত রাজা হিসেবে প্রভাব বিস্তারকারি জেলায় ৩ জন সার্কেল চিফ রয়েছেন। যারা উপজাতি। এছাড়াও ৩৮৯ জন হেডম্যান রয়েছেন। যার  প্রায় ৯৫ শতাংশ উপজাতি পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রায় ৫ হাজারের অধিক কার্বারী (পাড়া প্রধান) রয়েছেন যারা সবাই উপজাতি। এরাই তৃণমূল পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন করেন।

স্থানীয় সরকার কাঠামো:

২৬টি উপজেলার চেয়ারম্যান এবং ১১৬টি ইউনিয়ন পরিষদ ও ১,০৪৪টি ওয়ার্ডের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা অধিকাংশ পদে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা শাসন করছেন।

দ্বন্দ্বের মূল: ক্ষমতার ভারসাম্য না বৈষম্য?

প্রশাসনিক কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় জনগোষ্ঠির নেতৃবুন্দের হাতেই প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। অন্যদিকে বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব তুলনামূলকভাবে দুর্বল, বিশেষ করে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিষদগুলোতে।

তথ্যসূত্র: পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (উইকিপিডিয়া), পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও উন্নয়ন বোর্ডের সরকারি ওয়েবসাইট, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন ও গবেষণা প্রতিবেদন।

ভবিষ্যৎ ভাবনা; সমতা, স্বচ্ছতা ও শান্তি:

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনটি মূল স্তম্ভের উপর। যথা- এক. প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বা বিনা নির্বাচনে পরিচালিত পরিষদগুলোর গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন। দুই. নিরাপত্তার ভারসাম্য বা সেনা উপস্থিতি যেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, শাসন নয়। তিন. সামাজিক সংহতি বা উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা ও অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, বিশেষ অঞ্চল হিসেবে নিরাপত্তার বাস্তবতায়, সেনাবাহিনী দৃশ্যমান হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত আইন ও কাঠামো অনুযায়ী, উপজাতীয় নেতৃত্বই এখানে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আরও সহজভাবে বললে- পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন করছে উপজাতিরাই। তবে সংখ্যায় অর্ধেক জনসংখ্যা হলেও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে, বাঙালিরা প্রান্তিক।

এই বাস্তবতা থেকেই উঠে আসে দ্বন্দ্ব, অভিযোগ, এবং “সেনা শাসন বনাম উপজাতীয় আধিপত্য” বিতর্ক। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে গণতন্ত্র, সংলাপ ও সমতার ভিত্তিতে একটি নতুন কাঠামো নির্মাণের উপর। 

 

 

এ এইচ এম ফারুক

সাংবাদিক, লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।