মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত এখন আর শুধু দুই দেশের ভৌগোলিক সীমানা নয়; এটি পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক মাদকপথে। বিশেষ করে ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ (আইস) এবং অন্যান্য সিনথেটিক ড্রাগ প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে ঢুকছে, যার প্রধান শিকার দেশের তরুণসমাজ। আরাকান আর্মির (এএ) মাদক ব্যবসা আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাত আমাদের সমাজের ভবিষ্যৎকে সরাসরি ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই প্রবন্ধে আমরা দেখব কীভাবে মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তপথ ব্যবহার করে এই বিষ আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে এবং এর পেছনে কারা রয়েছে।
মূল হোতা বা অর্থদাতাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে কেবল বাহকদের দমন করায় এই আগ্রাসন থামানো যাচ্ছে না, যা জাতীয় নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা এবং অর্থনীতির ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করে মাদকাসক্তিকে এখন দেশের জাতীয় নিরাপত্তা সংকট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
মাদক: এক জাতীয় নিরাপত্তা সংকট
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী,বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮৩ লাখ থেকে দেড় কোটি পর্যন্ত হতে পারে, যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই হলো ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সি তরুণ ও যুবক। উদ্বেগজনকভাবে, এই পরিসংখ্যানের মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার নারী এবং ২ লাখ ৫৫ হাজার শিশু-কিশোরও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপসমূহ আপাতদৃষ্টিতে কঠোর আইন ও বড় আকারের অভিযানের মাধ্যমে ‘বজ্র আঁটুনি’ দেখালেও, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ‘গডফাদার’ এবং তাদের অবৈধ অর্থায়নকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারা এবং সীমান্তের মূল সরবরাহ চেইন অক্ষত থাকা এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ‘ফস্কা গেরো’ হয়ে আছে, যার ফলস্বরূপ মাদক সাম্রাজ্য নির্বিঘ্নে টিকে থাকছে।
মাদক বাণিজ্যের কৌশল পরিবর্তন: নতুন রুটের উত্থান
দীর্ঘদিন ধরে বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা এলেও, সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি পাওয়ায় পাচারকারীরা এখন অভিনব কৌশল ও নতুন রুট ব্যবহার করতে শুরু করেছে। নাইক্ষ্যংছড়ি হয়ে ছাগলবাড়িয়া, দোছড়ি, আলীকদমের দুর্গম পাহাড়ি পথ, এমনকি সাগরপথে টেকনাফের বাইরে মহেশখালী ও সোনাদিয়াতেও গড়ে উঠেছে নতুন ‘ড্রপ পয়েন্ট’। পাচারকারীরা প্রতিনিয়ত কৌশল বদলাচ্ছে।
দেড় দশকে মাদক উদ্ধারের ‘অবিচ্ছিন্ন সরবরাহ’ চিত্র
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক উদ্ধারের পরও মাদকের প্রবাহ বন্ধ না হওয়া প্রমাণ করে যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে মাদকের সরবরাহ রুটগুলো এখনো প্রায় অক্ষত রয়েছে।
বিশাল উদ্ধারের পরিসংখ্যান
সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (র্যাব, বিজিবি, পুলিশ, কোস্টগার্ড, সেনাবাহিনী) এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সমন্বিত অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার হয়েছে। কেবল ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্তই ২২ কোটি ৩০ লাখের বেশি ইয়াবা পিস এবং ৬৫ লাখের বেশি ফেন্সিডিল বোতল উদ্ধার হয়েছে। এরপর ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ইয়াবা উদ্ধারের সংখ্যা আরও বেড়েছে, যা আনুমানিক ৩০ কোটি পিসের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
টেকনাফ ব্যাটালিয়নের তথ্য: টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমানের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার ২১৭ পিস ইয়াবা ট্যাবেলট এবং ১শ ৪৯ দশমিক ৯৩৩৮ কেজি ক্রিস্টাল মেথ আইস জব্দ করা হয়েছে। যার সিজার মূল্য মোট ১৮২৬ কোটি ৫২ রাখ ৫৫ হাজার ১০০ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ উদ্ধার মাদক চক্রের আর্থিক ক্ষমতা এবং আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের শক্তিকে ইঙ্গিত করে।(সূত্র: ডিএনসি, বিজিবি, র্যাব-এর সমন্বিত পরিসংখ্যান এবং জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন)
আরাকান আর্মির অর্থায়ন: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ
কক্সবাজারে মাদক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে আরাকান আর্মির সক্রিয় ভূমিকার কারণে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সশস্ত্র গ্রুপগুলো নিজেদের টিকে থাকা এবং অস্ত্র কেনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে মাদক পাচারের ওপর নির্ভর করছে। বিশেষত আরাকান আর্মি বর্তমানে ইয়াবা ও আইস ব্যবসা থেকে বিপুল আয় করছে, যা তাদের কার্যক্রম পরিচালনার অন্যতম প্রধান উৎস। মিয়ানমারের সীমান্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় তারা সহজেই সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশমুখী রুট নিয়ন্ত্রণ করছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার-টেকনাফ উপকূলরেখায় এদের স্থানীয় এজেন্ট, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় নেটওয়ার্ক এবং পাহাড়ি পথের গাইড রয়েছে।
মূল সিন্ডিকেট ও তিন স্তরের নেটওয়ার্ক
বাংলাদেশের মাদক সংকটের গভীরতার কারণ হলো, এটির মূল সিন্ডিকেটকে এখনো ভেঙে ফেলা যায়নি। সীমান্তের ওপারে মাদক উৎপাদন, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে মজুদ, পরে দেশের ভেতরে বিতরণ—সব মিলিয়ে এই নেটওয়ার্কে রয়েছে তিন স্তরের হাজারো ব্যক্তি। অনেক সময় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত সীমান্তকর্মী, এমনকি রাজনৈতিক ছত্রছায়াও লক্ষ করা যায়।
সংকট মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ
মিয়ানমার থেকে আসা মাদক বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করছে। সীমান্তের ওপারের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর টিকে থাকার অর্থনীতি যদি বাংলাদেশের যুবসমাজকে গ্রাস করে, তাহলে আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ সবকিছুই হুমকির মুখে পড়বে। তাই এখনই প্রয়োজন—
সমন্বিত নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি: শুধু বিজিবি নয়, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, র্যাব ও পুলিশের মধ্যে সমন্বিত উপস্থিতি বাড়াতে হবে। পাহাড়ি সীমান্তে ড্রোন নজরদারি, থার্মাল ক্যামেরা এবং রাডার প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাঠামো সংস্কার: ক্যাম্পের ভেতরে অপরাধ নেটওয়ার্ক ভাঙা ছাড়া মাদক প্রবাহ কমানো সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথেও সমন্বয় জরুরি।
কূটনৈতিক চাপ: মিয়ানমার-বাংলাদেশ যৌথ টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। সীমান্ত নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়াতে কূটনৈতিক চাপ, আঞ্চলিক ফোরামে চেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সহায়তা নেওয়া জরুরি।
উপসংহার
তাই এখনই প্রয়োজন স্বার্থান্বেষী চক্র ভেঙে ফেলা, প্রযুক্তিনির্ভর সীমান্ত সুরক্ষা, আন্তর্জাতিক চাপ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি।
সাংবাদিক, লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

