বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ বা ভিভিআইপি ঘোষণা করে তার নিরাপত্তায় স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পরই রাজনৈতিক মহলে নতুন প্রশ্ন—তারেক রহমান দেশে ফিরলে কি তিনিও এই ভিভিআইপি নিরাপত্তার আওতায় আসবেন?
এই প্রশ্ন শুধু বিএনপি মহলেই নয়, সাধারণ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যেও সমানভাবে আলোড়ন তুলেছে। কারণ দীর্ঘ ১৬ বছর যুক্তরাজ্যে থাকার পর তারেক রহমানের দেশে ফেরার জল্পনা যতই তীব্র হচ্ছে, ততই তার নিরাপত্তা প্রসঙ্গ বড় হয়ে উঠছে।
মঙ্গলবার সকালে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তবে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের সুযোগ না থাকায় সিদ্ধান্তের আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা তখন জানা যায়নি।
তিনি জানান, খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থা, হাসপাতালে তার নিরবচ্ছিন্ন চিকিৎসার প্রয়োজন, প্রয়োজনে বিদেশে নেওয়ার প্রস্তুতি, নিরাপত্তা ও যাতায়াতের সুবিধা বিবেচনায় তাকে ‘রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ বা ভিভিআইপি ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ ঘোষণার পর প্রজ্ঞাপন জারি হলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মতোই তার নিরাপত্তায় এসএসএফ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে এই সিদ্ধান্তে নতুন প্রশ্ন উঠেছে—খালেদা জিয়ার ছেলে এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরলে তিনিও কি এসএসএফ নিরাপত্তা পাবেন?
তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তিনি নিজেই ফেসবুকে জানিয়েছেন, দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত তার নিজের হাতে পুরোপুরি নেই। যদিও সোমবার রাতের একটি বৈঠক শেষে বিএনপির মুখপাত্র ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, তারেক রহমান খুব শিগগিরই দেশে ফিরবেন।
দলের বিভিন্ন নেতার বক্তব্য ও খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ দেখে অনেকের ধারণা, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরই দেশে ফিরতে পারেন তারেক রহমান।
তারেক রহমান দেশে ফিরলে একই সুবিধা পাবেন?
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে সরকার ‘ভিভিআইপি’ ঘোষণা করার পরই দুপুরের পর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে তার নিরাপত্তায় স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) সদস্যরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এসএসএফ অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ বা ভিভিআইপিদের শারীরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এ বাহিনীর মূল দায়িত্ব। আইনজীবীরা বলছেন, এই শ্রেণিতে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানের পাশাপাশি বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিশেষ মর্যাদা পাওয়া ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন।
উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তে খালেদা জিয়া ভিভিআইপি মর্যাদা পাওয়ায় তিনি এখন এসএসএফ নিরাপত্তার আওতায় পড়ছেন। তবে নতুন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—এ সুবিধা কি তার পরিবারের সদস্যদের ওপরও প্রযোজ্য হবে? দেশে ফিরলে তারেক রহমানও কি এসএসএফ সুরক্ষা পাবেন?
খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর জানান, তারেক রহমান দেশে এলে তার নিরাপত্তা বিবেচনায় এসএসএফ সুবিধার প্রস্তাব সরকারকে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির এক নেতা মনে করেন, ভিভিআইপি ঘোষিত ব্যক্তির নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবেই তার নিকটাত্মীয়দের ওপরও প্রযোজ্য হওয়া উচিত। তার ভাষায়, ‘সে ক্ষেত্রে তারেক রহমানের পৃথকভাবে আবেদন করার প্রয়োজন নেই; তিনিও এ সুবিধা পাবেন।’
এর আগে তারেক রহমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়ে ছিলেন, দেশে ফেরার বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা নেই। অনেকের ধারণা ছিল, নিরাপত্তাজনিত কারণেই তিনি এখনো দেশে ফিরছেন না।
বাংলাদেশে তিন ধরনের বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তি—ভিভিআইপি, ভিআইপি ও সিআইপি। এর মধ্যে ভিভিআইপি ও ভিআইপি নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে, আর সিআইপি মনোনয়ন দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। দেশের প্রধান ভিভিআইপি হলেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, যাদের নিরাপত্তায় প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট (পিজিআর) ও এসএসএফ কাজ করে। প্রয়োজন হলে রাষ্ট্র অন্যদেরও ভিআইপি বা ভিভিআইপি ঘোষণা করতে পারে এবং তাদের নিরাপত্তায় এসএসএফ নিয়োজিত হয়।
খালেদা জিয়াকে ভিভিআইপি ঘোষণা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হলে তার নিরাপত্তায় সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা কাজ শুরু করবে, যার ফলে এসএসএফ সুরক্ষা পাওয়া তার ক্ষেত্রে প্রায় নিশ্চিত।
এরশাদ সরকারের আমলে প্রেসিডেনশিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স গঠিত হলেও ১৯৯১ সালে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফেরার পর এটি সংশোধন করে বর্তমান স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই বাহিনীকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া আছে, যার মধ্যে রয়েছে গ্রেপ্তারসহ প্রয়োজনে নিরাপত্তার স্বার্থে অস্ত্র ব্যবহার করার ক্ষমতা।
যদিও ২০১৯ সালে ফেরি আটকে রাখায় এক স্কুলছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট মন্তব্য করেছিল যে ভিভিআইপি কেবল রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। তবে আইনের বিধান অনুযায়ী প্রয়োজন হলে রাষ্ট্র চাইলে অন্য কাউকেও ভিভিআইপি ঘোষণা করতে পারে।
ভিভিআইপি ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক
সোমবার রাত ১২টা ২৯ মিনিটে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়া তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় খালেদা জিয়ার একটি ছবি শেয়ার করে জানান, বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ (ভিভিআইপি) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে এবং তার নিরাপত্তায় বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (এসএসএফ) নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হবে।
তবে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত এ ধরনের কোনো প্রজ্ঞাপন সরকারি নথিপত্রে পাওয়া যায়নি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ওয়েবসাইটেও প্রজ্ঞাপনটির কোনো অস্তিত্ব দেখা যায়নি। পরে সকালে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক শেষে জানানো হয়—খালেদা জিয়াকে ভিভিআইপি ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত বৈঠকে গৃহীত হয়েছে।
খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ফজলে এলাহী আকবর দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে বিবিসি বাংলাকে বলেন, তখনো পর্যন্ত সরকারি কোনো গেজেট প্রকাশিত হয়নি। যদিও উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানিয়েছেন, ভিভিআইপি ঘোষণার বিষয়টি বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে জানে।
তারেক রহমানকেও এসএসএফ নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে সরকারের সাথে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে ফজলে এলাহী আকবর জানান, দেশে ফেরার পর তার নিরাপত্তা বিবেচনায় একটি প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে আগেই ঘোষণা করা হয়েছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলকে নেতৃত্ব দেবেন তারেক রহমান। দলীয় নেতারা বলেছিলেন, তিনি নভেম্বরেই দেশে ফিরবেন। কিন্তু ২৯ নভেম্বর তারেক রহমান নিজেই জানান, দেশে ফেরার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তার ‘একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়’।
তিনি বর্তমানে ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট রয়েছে কি না বা তিনি নতুন করে আবেদন করেছেন কি না—এসব বিষয়ে তিনি বা দল কেউই মুখ খুলেননি। সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য দেওয়া হয়নি। তবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, তারেক রহমান চাইলে একদিনেই তাকে ট্রাভেল পাস দেওয়া সম্ভব। তার ভাষায়, পাসপোর্ট না থাকলে বা মেয়াদোত্তীর্ণ হলে দেশে ফেরার জন্য একবারের ট্রাভেল পাস ইস্যু করা হয়।
অনেকে মনে করছেন, খালেদা জিয়ার ভিভিআইপি মর্যাদার ফলে পরিবারের সদস্য হিসেবে যদি তারেক রহমানও এসএসএফ সুরক্ষা পান, তবে তিনি দেশে পৌঁছানোর মুহূর্ত থেকেই এই নিরাপত্তা সুবিধা কার্যকর হতে পারে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা






সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন