টাকা, গাড়ি, বাড়ি আর সম্পদের পাহাড় গড়েছেন আওয়ামী লীগ নেত্রী জান্নাত আরা হেনরি। মাত্র ১৪ বছরে এই সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। সহকারী শিক্ষক থেকে সংসদ সদস্য। বলা যায়, শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক। মধ্যবিত্তের একটি সাধারণ ঘর আজ রাজপ্রাসাদের মতো গল্প বলে।
জান্নাত আরা হেনরি দ্বাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য ছিলেন ৬ মাস ২৫ দিন। তারপর জনরোষ থেকে বাঁচতে পলাতক। আত্মগোপনে থেকেও শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা পড়েন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। ছিলেন সিরাজগঞ্জ সদরের সবুজ কানন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। সেখান থেকে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে রাজনৈতিক নেত্রী এবং সংসদ সদস্য বনে যান। হেনরির অর্থসম্পদের পাহাড় গড়ার ইতিহাস রূপকথার মতোই বিস্ময়কর।
বর্তমানে হেনরির ব্যবহারযোগ্য গাড়ি ১৬টি। ঢাকা, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে ফ্ল্যাট, জমিসহ বিঘায় বিঘায় সম্পদ। ৩৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট ২ হাজার ২ কোটি ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৭ টাকার লেনদেন হয়েছে। এছাড়াও ১৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪৬ হাজার মার্কিন ডলার মানিলন্ডারিংয়ের তথ্য পেয়েছে দুদক।
দুদক কর্মকর্তা জানান, মাত্র ১৪ বছরে হেনরির উপার্জিত সম্পদের এই বিবরণ হচ্ছে খণ্ডিত চিত্র। এই চিত্র থেকে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে লুটপাটের রাজত্ব কিভাবে কায়েম হয়েছিল। দুদকের তদন্তাধীন রাজনীতিক থেকে শুরু করে অনুগত আমলাদের মামলা পর্যালোচনায় এমন চিত্র পাওয়া যায়।
২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ সদর আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান জান্নাত আরা হেনরি। তখন তিনি ছিলেন সিরাজগঞ্জ সদরের সবুজ কানন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। রবীন্দ্র সংগীতেরও চর্চা করতেন তিনি। স্কুলেও শিক্ষার্থীদের গানের তালিম দিতেন। সে সময় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান হেনরি। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় নির্বাচন কমিশনে রিটার্ন তথ্য ও সম্পদ বিবরণী জমা দেন। ওই সময় তার মাসিক আয় দেখান ১০ হাজার টাকা। নগদ অর্থ ছিল মাত্র সাড়ে ৪ লাখ টাকা।
এরপর এক যুগেরও বেশি সময় ধরে হেনরির আওয়ামী রাজনীতির ইতিহাস কেবলই বদলে যাওয়ার। ১৪ বছর পর দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসে কল্পকাহিনীর মতো দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য। তার সম্পদ ও আর্থিক হিসাবের বিবরণ যেন রাজকোষকেও হার মানানোর প্রতিযোগিতা।
২০০৮ সালেও যিনি রিকশায় চড়ে স্কুলে যেতেন, তিনি বর্তমানে ১৬টি গাড়ির মালিক। সবগুলো গাড়িই ঢাকা মেট্রো-১, মিরপুর সার্কেল থেকে রেজিস্ট্রেশন করা। হেনরি নিজে যেই গাড়িতে চড়েন সেটির (ঢাকা মেট্রো-ঘ-২১-৭৩৮৮) ক্রয়মূল্য দেখিয়েছেন ৯৫ লাখ টাকা। দুদক তদন্ত কর্মকর্তার ধারণা, এই গাড়ির দাম কমপক্ষে ২ কোটি টাকা।
হেনরি পরিবারের সদস্যরা আরেকটি গাড়ি ব্যবহার করেন, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ-১২-২০৪৯। বিআরটিএতে এই গাড়ির ক্রয়মূল্য দেখিয়েছেন ৬১ লাখ টাকা।
অবশিষ্ট ১৪টির মধ্যে রয়েছে ঢাকা মেট্রো-চ-৫২-২৯০১, প্রদর্শিত মূল্য ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা; ঢাকা মেট্রো-চ-৫২-২৯০০, প্রদর্শিত মূল্য ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা; ঢাকা মেট্রো-চ-৫২-২৯৮০, প্রদর্শিত মূল্য ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা; ঢাকা মেট্রো-চ-১৯-৭৫২৪, প্রদর্শিত মূল্য ১৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা; ঢাকা মেট্রো-চ-৫৬-৪২০০, প্রদর্শিত মূল্য ২১ লাখ টাকা; ঢাকা মেট্রো-ঝ-১১-১১৩২, প্রদর্শিত মূল্য ৩২ লাখ টাকা; ঢাকা মেট্রো-চ-৫৬-২৮৯৫, প্রদর্শিত মূল্য ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা; ঢাকা মেট্রো-চ-১৯-৩৭৮২, প্রদর্শিত মূল্য ১৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা; ঢাকা মেট্রো-গ-৩২-২২৭৭, প্রদর্শিত মূল্য ২৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা; ঢাকা মেট্রো-গ-৩২-০৪৭৪, প্রদর্শিত মূল্য ২৬ লাখ টাকা; ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-৩৯৯০, প্রদর্শিত মূল্য ১৫ লাখ টাকা; ঢাকা মেট্রো-গ-৩৯-১৫০৩, প্রদর্শিত মূল্য ১৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা; ঢাকা মেট্রো-চ-১৫-৪৫৬৩, প্রদর্শিত মূল্য ১৬ লাখ টাকা এবং ঢাকা মেট্রো-ঠ-১১-৯৯১৩, যেটির প্রদর্শিত মূল্য ১২ লাখ টাকা।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির রুমানা মাহমুদের কাছে হেরে যান হেনরি। তখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে জান্নাত আরা হেনরিকে সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক করা হয়। এরপর থেকে তার রোজগারের মেশিন যেন কয়েকশ গুণ গতি পায়। হলমার্ক কেলেঙ্কারির সুবিধাভোগী, ঋণ প্রদান, পদোন্নতির তদবির পূরণসহ তৎকালীন আওয়ামী সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে তদবির বাণিজ্যে দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন হেনরি। বিভিন্নভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে টাকার কুমিরে পরিণত হন রাতারাতি।
দুদক আদালতকে জানিয়েছে, ‘দুর্নীতি ও ঘুস’ সংঘটনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ ও অবৈধ অর্জিত সম্পদ আড়াল করেছে হেনরি। তার ৩৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২ হাজার ২ কোটি ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৭ টাকা এবং ১৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪৬ হাজার মার্কিন ডলারের সন্দেহজনক লেনদেন করে মানিলন্ডারিং করেছেন। অধিকাংশ সম্পদের তথ্য আয়কর নথিতে উল্লেখ করেনি। ৫৭ কোটি ১৩ লাখ ৭ হাজার ২২৩ টাকা জ্ঞাত আয় উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন করেছেন সাবেক এই এমপি।
হেনরির সম্পদের মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ সদরে ৭ তলা ভবন, যার দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সিরাজগঞ্জে ১টি ফ্ল্যাট, দলিলমূল্য ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ঢাকার মিরপুরে রজনীগন্ধা কমপ্লেক্সে ২টি ফ্ল্যাটের মূল্য ৫০ লাখ টাকা; সিরাজগঞ্জের বাহুকা রতনকান্দি এলাকায় ৪ হাজার বর্গফুটের ২ তলা ভবনের মূল্য ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা; সিরাজগঞ্জের ভূতেরদিয়া এলাকায় ০.০৬৩৭ শতাংশ জমিসহ ভবনের মূল্য (দলিল নং-৪৩৮০) ৮২ লাখ ১৪ হাজার টাকা; ভূতেরদিয়ায় ০.০৭০০ একর জমি (দলিল নং ৭৩০২) মূল্য ২ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার টাকা এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কামতা মৌজার ১৭নং সেক্টরের ৪০২ নং সড়কের ৮ নং প্লটের ৫ কাঠা জমির (দলিল নং-৪৫৩৬) মূল্য দেখিয়েছেন ২২ লাখ ২০ হাজার টাকা। একই সেক্টরের ৩০৫নং সড়কের ৪নং প্লটের ৪ কাঠা জমি (দলিল নং-৫৯৩৭) ক্রয় করেছেন ২২ লাখ ২০ হাজার দলিলমূল্য দেখিয়ে। পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় ২.৫১ একর জমি কিনেছেন (দলিল নং-২৫৭৪) ১ কোটি ১০ লাখ ৯২ হাজার টাকায়।
সিরাজগঞ্জ সদরের বাহুকা-রতনকান্দি এলাকায় ১১টি পৃথক দলিলে (দলিল নং-৬৬৮৮, ৬৬৩৯, ৮২২, ৩৮৫৯, ৩৯৬৯, ৪৫৭৭, ৬১৮৫, ০৮০৮, ৩৮১০, ৩৯৫৬) সাড়ে ৩ একর জমি ক্রয় করেছেন। এসব সম্পদের দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে ৫৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা। সিরাজগঞ্জের পূর্ব মোহনপুরে ০.৬১ একর জমি কিনেছেন (দলিল নং ৪৫৭৬ ও ৪৫৭৭) ১৯ লাখ ৮৬ হাজার ১৮০ টাকা মূল্যে। শিলন্দা ও বনবাড়ীয়ায় ৪.৬ একর জমি ক্রয় করেছেন (দলিল নং-১০৬১৩, ২৬৯৮, ২৬৯৯) ১ কোটি ৬ লাখ ৯০ হাজার ৫৫৬ টাকা দলিলমূল্যে। সদানন্দপুরে ৫টি পৃথক দলিলে ৪৫.১৫ শতাংশ জমি কিনেছেন ৭৮ লাখ ৮৮ হাজার ৪৯৩ টাকায়, যা আয়কর নথিতে প্রদর্শিত আছে।
এছাড়া সিরাজগঞ্জের ভারাঙ্গা এলাকায় ১২টি পৃথক দলিলে (দলিল নং-৯৬৯, ৯৬৭, ৯৬৮, ৯৭১, ১২৪৬, ১০১৮, ৩৯৫৬, ১১১৬, ১০১৫, ৯৭২, ১৮০৭) ৫ একর সম্পত্তি ক্রয় করেছেন ১ কোটি ১১ লাখ ৩৬ হাজার ৪০০ টাকা দলিলমূল্যে। রায়গঞ্জে ২.১৮ একর জমি (দলিল ৪৮৯৭) মূল্য ৩০ লাখ টাকা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর জান্নাত আরা হেনরি ও তার স্বামী শামীম তালুকদার লাবু আত্মগোপনে চলে যান। তবে একই বছর ৩০ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার থেকে গ্রেফতার হন। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন। দুদক তাদের আরও সম্পদের উৎস তদন্ত করছে। সন্ধান পাওয়া এসব সম্পদ যেন হস্তান্তর বা স্থানান্তর করতে না পারে সেজন্য আদালতে রিসিভার নিয়োগের আবেদন জানালে আদালত তা মঞ্জুর করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :