মানুষের জীবনে জীবিকা, প্রশান্তি ও সমৃদ্ধির গুরুত্ব অপরিসীম। এ লক্ষ্যেই সে প্রতিনিয়ত পরিশ্রম করে, সময় ব্যয় করে এবং নানা পথ অনুসরণ করে থাকে। কিন্তু পবিত্র কুরআন ও হাদিস আমাদের এমন একটি উপায় জানিয়ে দিয়েছে, যা অত্যন্ত সহজ, বরকতময় এবং সব ধরনের কল্যাণ লাভের শক্তিশালী মাধ্যম। তা হলো ইস্তিগফার অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা।
অনেকেই ইস্তিগফারকে শুধু পাপ মোচনের জন্য প্রয়োজনীয় মনে করেন। যদিও পাপমুক্তি ইস্তিগফারের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য, তবে কুরআন ও হাদিস আমাদের এও জানায় যে, ইস্তিগফার দুনিয়াবি সফলতা, প্রশান্তি এবং রিজিক বৃদ্ধির এক পরীক্ষিত চাবিকাঠি। ইস্তিগফার শুধু আত্মশুদ্ধির মাধ্যম নয়, বরং জীবনের সংকট ও অভাব দূর করার এক অলৌকিক উপায়।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে নবি নুহ (আ.)-এর বাণী উদ্ধৃত করে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, তিনি তো অতি ক্ষমাশীল। (তোমরা তা করলে) তিনি আকাশ থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততির প্রাচুর্য দান করবেন, তোমাদের জন্য বাগান ও নদীনালা সৃষ্টি করবেন।’ (সুরা নুহ: ১০-১২)। এ আয়াতগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, ইস্তিগফার আমাদের দুনিয়াবি জীবনে অভাব মোচন এবং প্রাচুর্যের দুয়ার খুলে দেয়।
একইভাবে সুরা হুদে হুদ (আ.) বলেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা ইস্তিগফার করো এবং আল্লাহর কাছে তাওবা করো। (তোমরা তা করলে) তিনি তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের শক্তি বাড়িয়ে দেবেন।’ (হুদ: ৫২)।
এই আয়াতেও দেখা যায়, ইস্তিগফারের ফলে আকাশের বরকত নেমে আসে এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
তাফসিরবিদগণ এ বিষয়ে বিশেষভাবে আলোকপাত করেছেন। ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘এই আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে ইস্তিগফার জীবিকা বৃদ্ধির কারণ এবং আকাশ থেকে বৃষ্টিপাতের মাধ্যম।’
হাফেজ ইবনে কাসির (রহ.)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ‘যখন মানুষ আল্লাহর কাছে তাওবা ও ইস্তিগফার করে এবং তার আনুগত্যে ফিরে আসে, তখন আল্লাহ আসমান থেকে বরকত নাজিল করেন, জমিন ফল-ফসলে ভরে ওঠে, প্রাণীরা দুধে পূর্ণ হয় এবং চারপাশে সৃষ্টি হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রাচুর্য।’
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসেও ইস্তিগফারের দুনিয়াবি সুফল স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার করবে, আল্লাহ তার জন্য প্রতিটি দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির পথ খুলে দেবেন, প্রতিটি সংকীর্ণতা থেকে উত্তরণের উপায় করে দেবেন এবং এমন উৎস থেকে জীবিকার ব্যবস্থা করবেন, যেখান থেকে সে কল্পনাও করতে পারেনি।’ (মুসনাদে আহমাদ, সুনানে নাসায়ি)।
এই হাদিসে তিনটি অমূল্য নেয়ামতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে—দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি, সংকট থেকে মুক্তি এবং অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে জীবিকা লাভ।
ইস্তিগফারের আরও একটি চমৎকার প্রভাব আমরা দেখি সুরা হুদ-এর ৩ নম্বর আয়াতে। সেখানে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ইস্তিগফার করো ও তাওবা করো, তাহলে তিনি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম উপভোগ সামগ্রী দান করবেন।’
ইবনে আব্বাস (রা.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘এতে বোঝানো হয়েছে, আল্লাহ তোমাদের জীবনে প্রশান্তি, প্রাচুর্য ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দান করবেন।’
তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে—ইস্তিগফার যেন কেবল মুখের বুলি না হয়, বরং তা যেন অন্তরের অনুতাপ ও জীবনের আমলে প্রতিফলিত হয়। কেউ যদি মুখে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলেও গোনাহে লিপ্ত থাকে, সে ব্যক্তি নিজেকেই ধোঁকা দিচ্ছে। ইস্তিগফারের প্রকৃত ফল পেতে হলে পাপ ত্যাগ করে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে হবে।
সুতরাং, যারা জীবনে বরকতপূর্ণ জীবিকা, মনের প্রশান্তি এবং পরিবার-সমাজে উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন, তাদের জন্য ইস্তিগফারই হতে পারে সবচেয়ে সহজ ও নিশ্চিত উপায়। এটি শুধু পরকালের পাথেয় নয়, বরং দুনিয়ার কল্যাণ লাভের সোনার চাবিও বটে। আল্লাহর দরবারে ফিরে যাওয়া, গোনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং আন্তরিকভাবে তার ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে আমরা দুনিয়াতে স্বস্তি ও আখিরাতে মুক্তির পথ তৈরি করতে পারি।
আসুন, সবাই নিজেদের জীবনে ইস্তিগফারকে নিয়মিত করে তুলি। দিনে-রাতে বারবার বলি, ‘আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাযি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম, ওয়া আতুবু ইলাইহি।’
(আমি ক্ষমা চাই আল্লাহর কাছে, যিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই; তিনি চিরঞ্জীব, সর্বধারক, এবং আমি তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করি।)
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন