৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস পূর্ণ হচ্ছে আজ। নতুন সরকারের জন্য যদিও এই তিন মাস যথেষ্ট নয়; তবুও সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে রয়েছে আলোচনা। স্বল্প সময়ে এই সরকারের যা অর্জিত তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা।
বিশেষ করে অর্থনৈতিক ভঙ্গুর অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। ধ্বংসস্তূপ থেকে চরম সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় কিঞ্চিত সাফল্য পেলেও সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই সাধারণের নিত্যপণ্যের বাজার। উন্নয়ন হয়নি আইনশৃঙ্খলারও। পাশাপাশি আলোচনায় উঠে আসছে রাষ্ট্র সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কারসহ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণের বিষয়গুলোও। তবে সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে নানা দাবিতে বিক্ষোভ-সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট এখন আর নেই। এই সময়ে সরকারের সব সেক্টরে কর্মপরিবেশ ফিরলেও কাটেনি স্থবিরতা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসহযোগিতার মনোভাব এখনো স্পষ্ট।
রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক সংস্কার, আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন ও গতিশীল করতে পুলিশ বাহিনীতে পদায়ন-প্রত্যাহার-পরিবর্তন, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ, নিভু নিভু আলো জ্বলা ব্যাংক-ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক সংস্কার, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার ও দুর্নীতি বন্ধে নানা উদ্যোগের পাশাপাশি বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। আবার সরকারের গৃহিত কোনো কোনো সিদ্ধান্ত কাজেই আসেনি। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে নেওয়া পদক্ষেপেও গতি আসেনি পুলিশ বাহিনীতে। থানার কার্যক্রম এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় স্থবিরতা দৃশ্যমান। যদিও সরকারের উপদেষ্টারা সাধারণ মানুষের প্রত্যাশ্যা পূরণে তাদের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
রাজনীতিকরা বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করে নতুন বাংলাদেশ গড়তে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছিল। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাস ধ্বংসস্তূপে থেকে কাজ করেছে। তিন মাস খুবই সীমিত সময়। সীমিত সময়ে ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা এবং বৈষম্য নিরসনসহ রাষ্ট্র সংস্কারের একগুচ্ছ চাপ রয়েছে তাদের ওপর। একটু সময় তাদের দিতে হবে। নিশ্চয়ই তারা ঘুরে দাঁড়াবে।
এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত বুধবার বলেছেন, তিন মাস অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট সময় নয়। বিজয়ের আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো; তবে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন না। সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
তিনি মনে করেন, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করছে। একটু সময় তাদের দিতে হবে। অধৈর্য হয়ে গেলে লাভের চেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সময় দেওয়া দরকার। আমি আশাবাদী হতে চাই। নিশ্চয়ই ঘুরে দাঁড়াবে সরকার।
বৈষম্যবিরাধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ৩ মাস পূর্ণ হচ্ছে। গত ৮ আগস্ট শপথ নিয়েছিল এই সরকার। এরপর উপদেষ্টা পরিষদের কলেবর বৃদ্ধি পায়। ২১ উপদেষ্টাকে নিয়ে এগিয়ে চলা শুরু হয় নতুন সরকারের। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেওয়া এই সরকার থাকবে কতদিন, তা সর্বত্রই আলোচিত হচ্ছে; যদিও তাদের ওপর রয়েছে ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা এবং বৈষম্য নিরসনসহ রাষ্ট্র সংস্কারের একগুচ্ছ চাপ। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রকৃত পক্ষে কর্মচারীদের দলবাজিতে কাটেনি অস্বস্তিকর অবস্থা। আন্দোলন, মিছিল-মিটিং না থাকায় সেখানে ফিরেছে কাজের পরিবেশ। তবে এই সময়ে সরকারের সব সেক্টরে কর্মপরিবেশ ফিরলেও কাটেনি স্থবিরতা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসহযোগিতার মনোভাব স্পষ্ট। সরেজমিন দেখা গেছে, একটি রাজনৈতিক দলের সরাসরি সমর্থক তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাপটে সচিবালয়ে এখনো অস্বাভাবিক কর্মপরিবেশ বিরাজ করছে। মুখে না বললেও এসব কর্মচারীর আচরণে এখনো উদ্বেগে রয়েছেন সচিবরা। সরকারের শীর্ষ মহলের উদ্যোগ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো কোনো মিটিংয়ে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার মদদপুষ্ট প্রশাসন ভেঙে ফেলতে হবে। সেখানে নিয়োগ দিতে হবে পদবঞ্চিতদের। এর অংশ হিসেবে কাউকে কাউকে নিয়োগ দেওয়াও হয়েছে, আলোচনা চলছে আরও দেওয়া হবে। এমন পরিস্থিতিতে নিজের পদ-পদবি ঠিক থাকবে কি না এ নিয়ে সারাক্ষণই আতঙ্কে রয়েছেন সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এতে সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষকে সেবা দেওয়ার পরিধি কমছে।
সূত্র জানায়, বিসিএস ১৩তম থেকে ২২তম ব্যাচের প্রশাসন ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পদোন্নতির দাবি জানিয়ে আবেদন করেছেন। ওই স্মারকলিপিতে তারা ২০০২ সালে প্রণীত সরকারের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালার বৈষম্য রয়েছে বলে দাবি করেন। এই মুহূর্তে ১৯৪ জন কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত রয়েছেন বলে তারা জানান। বিধিমালা অনুযায়ী, প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ এবং (অন্য ২৫টি ক্যাডার) অন্যান্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ উপসচিব পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন। একইভাবে যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিবও পদোন্নতি পাচ্ছেন। তারা মেধার ভিত্তিতে পদোন্নতিতে সমতা নিশ্চিতের দাবি জানান। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে কর্মচারী-নেতাদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানানো হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিষয়গুলো সংশোধন ও পরিবর্তনে কাজ চলছে। ১৬ বছর ধরে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একমাত্র সংগঠন সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ বিগত সরকারের আমলে চাকরিচ্যুত-সাময়িক বরখাস্ত ও অন্যায়ভাবে বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্তদের মতো পাওনা ফেরত, বিভিন্ন ক্যাটাগরির পদ সংরক্ষণ, পদনাম পরিবর্তন, নতুন পে-কমিশন গঠনসহ ৯ দফা দাবি দিয়েছে সরকারকে। দ্রুত এসব দাবি বাস্তবায়নের অনুরোধ জানিয়েছে সংগঠনটি।
এদিকে, সরকারি চাকরিবিধি-২০১৮ অনুযায়ী, সরকারি অফিসের নিয়ম ও শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করলে চাকরি চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর তাই এটি কেউ সরকারি চাকরি চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে তালিকায় রাখতে পারেন। কেননা, কেউ যদি অফিসের নিয়ম লঙ্ঘন করেন, তাহলে সেটা অফিসের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায় এবং অন্যদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ জন্য সাময়িক সময়ের জন্য হোক, অথবা চিরতরে অভিযুক্ত কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক কেবিনেট সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়া রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত থেকে নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ে সরকারকে বাধ্য করার যেকোনো কৌশলই দণ্ডনীয় অপরাধ। নিজেদের বা গোষ্ঠীগত দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন দাখিলই একমাত্র পথ। এ ক্ষেত্রে বিক্ষোভ মিছিল করা, ডিউটির সময়ে দপ্তরে অনুপস্থিত থাকা, কোথাও গণ্ডগোল পাকানো সবই সরকারি চাকরিবিধিতে অপরাধযোগ্য কাজ।
জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস-উর রহমান বলেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত থেকে যেকোনো উদ্দেশ্যে সরকারকে চাপে রাখার যেকোনো কৌশলই অপরাধ। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ে দপ্তরে অনুপস্থিত থাকাটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। সম্প্রতি যারা এসব কাজে যুক্ত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে এরই মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কতদিন হওয়া উচিত তা জানতে চাইলে রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে নজিরবিহীন ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য অপরিহার্য রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভীষ্ট অর্জনের যে গুরুদায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে অর্পিত হয়েছে, তা সম্পন্ন করতে যত সময় লাগবে, ততটাই তাদের হাতে থাকা উচিত। কোনো সুনির্দিষ্ট টাইমলাইনের প্রশ্ন এ পর্যায়ে যৌক্তিক মনে করেন না তিনি। এর আগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো তিন মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন করেছিল। এরপর ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোও নির্ধারিত তিন মাস সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করেছে। তবে ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিল।
আপনার মতামত লিখুন :