সঅবরোধে রাজধানীর শাহবাগ মোড় স্থবির। প্লে-কার্ড, ব্যানার হাতে অবরোধে শাহবাগ এলাকায় যান চলাচল বন্ধ। ’২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদদের স্বজনদের কান্না, আর্তনাদ আর দীর্ঘশ্বাসে ভারী পরিবেশ।
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় শাহবাগ অবরোধ করেন শহিদ পরিবারের স্বজনেরা। অবরোধের ফলে তীব্র যানজট তৈরি হয় শহরজুড়ে। ভোগান্তিতে পড়েন রোগী, রোগীর স্বজন ও পথচারীরা। তারা আজই (গতকাল) প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ চান। এ সময় রূপালী বাংলাদেশের কথা হয় শহিদদের স্বজনদের সঙ্গে।
নৌবাহিনী কলেজের শিক্ষার্থী শহিদ গোলাম নাফিজের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের শহিদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার আমাদের। আমরা ৬ মাস অপেক্ষা করছি। তবে দুঃখজনকভাবে আমরা কোনো বিচার পাইনি।
নাফিজের মা এই দুপুরে জোহরের নামাজ পড়ে তার জন্য দোয়া করবেন, কিন্তু কেন আমাদের বিচারের দাবিতে শাহবাগ আসতে হবে। আমার ভাবতে লজ্জা লাগে যে, আমরা শহিদের মা, গর্বিত মা! আমাদের সম্মান কোথায়!
টেনে রাস্তায় নামানো হয়েছে! আমরা খয়রাতি না, আমাদের সন্তানদের হত্যার সঠিক বিচার, ন্যায্য অধিকার ও পুনর্বাসন চাই। ২৪-এর শহিদেরা এখনো রাষ্ট্রীয় সম্মান পায়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অন্তর্বর্তী সরকার যদি হত্যার সঠিক বিচার করতে না পারে তবে, এই দায় কে নেবে! আমরা চাই সন্তানদের যারা হত্যা করেছে তাদের অতিদ্রুত ফাঁসি কার্যকর করা হোক।
আমার ছেলেকে আন্দোলনের সময় ফার্মগেটে বুকের ভেতর গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে। তার রক্তেই তো এই স্বাধীনতা। সেই রক্তের কি কোনো দাম দিচ্ছে এই সরকার! হাসিনার আমলে দেখেছি, আসামি ধরলে তারা হাঁটতে পারত না। এখন আসামি ধরলে তারা হাসতে হাসতে বিচারের জন্য যায়। আবার অনেক আসামি এই ৫ আগস্টের পরও পালিয়ে যায়।
এগুলো কি শহিদ ও শহিদ পরিবারের সঙ্গে সুবিচার করা হচ্ছে, প্রশ্ন রাখেন শহিদ নাফিজের মা।
তিনি বলেন, আমার সন্তানের খোঁজ নিতে বা আমার পরিবারের সাথে সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যোগাযোগ করেননি। তাদের কি দায় ছিল না খবর নেওয়ার? আমরা ঘরে ছিলাম লাস্ট ৬ মাস। আমাদেরকে ঘর থেকে বাধ্য করা হয়েছে রাজপথে নামতে। রাজপথে যেহেতু নেমেছি, বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রাস্তা ছাড়ব না।
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমরা সন্তানহারা মায়েরা আজ অধিকার ও বিচারের জন্য রাজপথে দাঁড়িয়েছি।
অন্যদিকে তারা শহিদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে সরকার গঠন করে এখন এসির ভেতর আয়েশি জীবনযাপন করছেন। জালিমের জুলুম থেকে দেশ উদ্ধারের পরও আজ আমরা বিচার পাচ্ছি না, এটা লজ্জার বিষয়।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক শহিদের স্ত্রী বলেন, আমার দুটি ছোট মেয়ে নিয়ে আমি খেয়ে না-খেয়ে দিন পার করছি। সরকারের উচিত ছিল আমাদের দায়ভার গ্রহণ করা।
’৭১-এর শহিদ পরিবার যদি সুবিধা পায়, সেখানে ’২৪-এর শহিদ পরিবার এমন অবহেলিত হবে এটা এই সরকার ও জাতির জন্য লজ্জার। অভ্যুত্থানের প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচারের লক্ষ্যে আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার, শহিদ ও আহত ভাইদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়াসহ পাঁচ দফা দাবিতে গতকাল শাহবাগ অবরোধ করেন শহিদ পরিবারের স্বজনেরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আশুলিয়া এলাকায় শহিদ আসিফের মা বলেন, আমি এক সন্তানহারা মা। আমার একটামাত্র ছেলে ছিল।
আমি ক্লিনিংয়ের কাজ করে আমার সন্তানকে সিটি ইউনিভার্সিটিতে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি করিয়েছিলাম। স্বপ্ন ছিল আমার ছেলে হবে ইঞ্জিনিয়ার, আমি হব ইঞ্জিনিয়ারের মা। আমার ছেলেকে আশুলিয়ায় মেরে লাশের স্তূপ করে তাতে নির্মমভাবে আগুন দেওয়া হয়েছিল।
এই সরকার আমাদের সন্তানদের রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই সরকার কেন তাদের রাষ্ট্রীয় সম্মান দিল না? একাত্তরের শহিদের জন্য যদি এত কিছু করা হয়; আমরা চব্বিশের শহিদের মা, আমাদের কেন কোনো মূল্য থাকবে না? আমরা কেন কোথাও গেলে হয়রানির শিকার হব?
যশোর থেকে দাবি নিয়ে শাহবাগে অবস্থান করছেন সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শহিদ ইমতিয়াজ আহমেদ জাবেদের বাবা।
তিনি বলেন, আমার একটা মাত্র আদরের সন্তান ছিল। সে জুলাই আন্দোলনে হাসিনার জুলুমের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে জীবন দান করেছে।
সরকার আমাদের নানান স্বপ্ন দেখালেও তার কোনো কিছুই বাস্তবায়ন করেনি। আমাদের সন্তানদের হত্যার যে বিচার, সেটাও করতে পারেনি এই সরকার।
আওয়ামী দোসররা এখনো বহাল তবিয়তে ঘুরছে আর আমরা বিচারের দাবিতে আজ রাজপথে এই দায় সরকারের। এই লজ্জা জাতির। যারা আমার সন্তানের হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। তাদের ফাঁসি বাংলার জমিতে হতে হবে।
সমন্বয়কদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যেসব সমন্বয়ক বড় বড় কথা বলেছিল, ৫ আগস্টের পর শহিদ পরিবারকে নানাভাবে আশার বাণী শুনিয়েছিল, সেসব সমন্বয়ক আজ গাড়িতে করে সারা দেশে শোডাউন দিয়ে বেড়ায়। আমাদের সাথে দেখা করার সময় তাদের নেই।
আজ শহিদের বাবা হয়ে আমি রাজপথে বিচার ও অধিকার আদায়ের জন্য। জীবন দিল আমাদের সন্তান, আহত হলো আমাদের সন্তানেরা আর কিছু সমন্বয়ক বিলাসী জীবনযাপন করছে, এটা লজ্জার।
বিচার না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এক শহিদের ভাই বলেন, আমাদের রাস্তায় নামতে হয়েছে কেন বলতে পারেন? সবার কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম, আমার ভাইয়ের বউ আছে, ছোট ৮ মাসের ছেলে আছে। তাদের কী হবে? এ রকম অনেক পরিবার আছে, যারা ভাত পাচ্ছে না, কাপড় পাচ্ছে না।
এদিকে, অবরোধের ফলে শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বারডেম জেনারেল হাসপাতালে থাকা রোগী ও তার স্বজনদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে শাহবাগের বারডেম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা নানা সমস্যায় ভোগা রোগীরা পড়েন চরম ভোগান্তিতে। কারওয়ান বাজার থেকে শাহবাগমুখী রাস্তায় সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাস, সিএনজিসহ নানা যানবাহনে আটকে থাকে মানুষজন।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন