২০০৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১২ লাখ ৩৪ হাজার ৩১০ জন নারী কর্মী কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবে নারী কর্মী গেছেন ৫ লাখ ৭৩ হাজার ৮৩ জন। তবে দেশটি থেকে নানা কারণে ফেরত এসেছেন অনেকে। বিদেশ থেকে ফিরে আসা কর্মীদের কোনো হিসাব নেই সরকারি সংস্থার কাছে।
তবে যারা পাসপোর্ট হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আউটপাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতিপত্র) নিয়ে ফিরে আসেন, তাদের হিসাব রাখে বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক। মূলত করোনা মহামারির পর থেকে দেশে কমেছে নারী অভিবাসন। মহামারির আগে দেশের মোট অভিবাসনের ১০ শতাংশ নারী কর্মী হলেও মহামারির পর তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
২০২২ সালে নারী কর্মী অভিবাসনের হার হঠাৎ বেড়ে গেলেও ২০২৩ সালে আবার কমে যায়। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে তা আরও কমেছে। ২০২৫ সালের দুই মাসে ১০ হাজার ৩৬১ জন নারী কর্মী বিদেশে গেছেন। অভিবাসন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, শোভন কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চয়তা, নারী কর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত না করা, দক্ষতা না থাকা, বিদেশে নির্যাতনের শিকারসহ নানা কারণে অভিবাসনের হার কমেছে।
বিএমইটির তথ্য বলছে, ২০০৪ থেকে ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২১ বছরে বিদেশে গেছেন ১২ লাখ ৩৪ হাজার ৩১০ জন নারী কর্মী। তারা যেসব দেশে কাজের উদ্দেশে যান, তার মধ্যে সবার ওপরে সৌদি আরবের অবস্থান।
গত ২১ বছরে ৫ লাখ ৭৩ হাজার ৮৩ জন নারী কর্মী সৌদি আরবে গেছেন। তাদের বেশির ভাগই গৃহকর্মী। এরপর নারী কর্মীদের গন্তব্য হচ্ছে জর্ডান। ২০০৪ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৯ হাজার ৬৭৩ জন নারী কর্মী সে দেশে গেছেন।
জর্ডানে বেশির ভাগ নারী কর্মী যান গার্মেন্টসের কাজে। এরপর আছে দুবাই। গত ২১ বছরে দুবাইয়ে গেছেন ১ লাখ ৩৩ হাজার ১২৭ জন নারী কর্মী। দুবাইয়ের পর আছে ওমান। তবে বেশ কিছু দেশে ভিসা বন্ধ থাকায় তার প্রভাবও পড়েছে অভিবাসনের হারে।
দেশটিতে গেছেন ১ লাখ ২০ হাজার ৯৫ জন নারী কর্মী। এছাড়া লেবাননে ১ লাখ ৮ হাজার ৮৮৯, কাতারে ৪১ হাজার ৩৬৯, মারিশাসে ১৯ হাজার ৯৮, কুয়েতে ৭ হাজার ৩০০, যুক্তরাজ্যে ৭ হাজার ১৮১, বাহরাইনে ৩ হাজার ১৭২, মালয়েশিয়ায় ১ হাজার ৮৪৮, সিঙ্গাপুরে ১ হাজার ৬৭৬, লিবিয়ায় ৬০৪, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০৬, ইতালিতে ৭৪০, জাপানে ৩২৫, হংকংয়ে ২ হাজার ৩৭০, পাকিস্তানে ৬৯, সাইপ্রাসে ৩৬৪ ও ব্রুনাইয়ে ১১৪ জন নারী কর্মী কাজের সন্ধানে পাড়ি জমিয়েছেন।
বিএমইটির তথ্য বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নারী অভিবাসন ১ লাখের বেশি ছিল, কিন্তু করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে নারী অভিবাসনের ধারা কমে গিয়েছিল। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে মোট ১ লাখ ৫ হাজার ৪৬৬ জন নারী কর্মী কাজের জন্য বিদেশে গেছেন। ২০২১ সালের তুলনায় নারী অভিবাসনের হার ওই বছর ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
অন্যদিকে, ২০২৩ সালে কাজের উদ্দেশে বিদেশে যাওয়া নারী কর্মীর হার কমেছে ২৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ২০২৩ সালে ৭৬ হাজার ১০৮ জন নারী কর্মী বিদেশ গেছেন, যেখানে ২০২২ সালে বিদেশ যাওয়া নারী কর্মীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৫ হাজার ৪৬৬। গেল বছর ২০২৪ সালে নারী অভিবাসন হয়েছে ৬১ হাজার ১৫৮ জনের, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ১৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম।
ফিরে আসা নারী কর্মীর সংখ্যা জানে না কেউ
২০০৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত শুধু সৌদি আরবে নারী কর্মী গেছেন ৫ লাখ ৭৩ হাজার ৮৩ জন। তবে সে দেশ থেকে নানা কারণে ফেরত এসেছেন অনেকে। বিদেশ থেকে ফিরে আসা কর্মীদের কোনো হিসাব নেই সরকারি সংস্থার কাছে। তবে যারা পাসপোর্ট হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আউটপাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতিপত্র) নিয়ে ফিরে আসেন, তাদের হিসাব রাখে বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক।
বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা জানান, বিদেশ গিয়ে প্রত্যাশিত কাজ না পাওয়া, ঠিকমতো বেতন না পাওয়া, অতিরিক্ত কাজের চাপে অসুস্থতা, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা, শারীরিক নির্যাতন, স্বাস্থ্যগত সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা ও ভাষাগত প্রতিবন্ধকতাসহ নানা কারণে নারী কর্মীরা ফেরত আসেন।
দেশে ফিরে আসা নারী কর্মীরা গন্তব্য দেশের কাজ নিয়ে নানা অভিযোগ করেন। কেউ কেউ নির্যাতন-নিপীড়নের নানা অভিযোগ করেন। যৌন নির্যাতনের শিকার কেউ কেউ ফিরছেন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে। কাজের নিরাপদ পরিবেশ না থাকায় সৌদি আরব থেকে প্রায় প্রতি মাসেই নারী গৃহকর্মীরা ফিরে আসতে বাধ্য হন বলে জানান তারা।
১৯৯১ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে নারী কর্মী পাঠানো শুরু হয়। নির্যাতনের অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিলে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। নারী কর্মীদের বেশির ভাগই সৌদি আরবে যান গৃহকর্মী হিসেবে।
কর্মী বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থতা, বাড়ির জন্য কাতর হওয়া, কম বেতন কিংবা বিনা বেতনে কাজ করা, খাদ্যাভ্যাস ও ভাষার সমস্যার পাশাপাশি শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ বাড়তে থাকে ব্যাপক হারে।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘যেহেতু আমাদের নারী কর্মীরা বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্যে যান, সেখানে তাদের সুরক্ষা মেকানিজম, কাজের মান ও পরিবেশ কতটা উন্নতি হয়েছে, তা আমাদের নজরদারি করা উচিত। তবে আমাদের মনোযোগী হতে হবে দক্ষ কর্মী তৈরির দিকে।
কতসংখ্যক নারী শ্রমিককে সৌদি আরবে বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশে পাঠালাম, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, বিকল্প হিসেবে যদি গার্মেন্টস শ্রমিক বা দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারি, তাহলে সংখ্যায় কম গেলেও বেশি রেমিট্যান্স আনতে পারি। সুরক্ষাটাও ভালো থাকে এবং সেদিকেই দৃষ্টি দেওয়া উচিত।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন