ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫

উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্বে ইরান: খামেনির পতনের দ্বারপ্রান্তে কী ইসলামি শাসন?

সৈয়দ মুহাম্মদ আজম
প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০২৫, ০৫:২১ পিএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

ইরান বর্তমানে এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক অস্থিরতা দেশটির ভবিষ্যতকে গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর থেকে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে ক্ষমতায় আছেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। তিনি এখন ৮৬ বছরের বৃদ্ধ, শারীরিকভাবে দুর্বল এবং রাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে রয়েছেন।

২০২২-২৩ সালের নারী-নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহে তার শাসনাভারে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। খামেনি বর্তমানে এমন এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, যখন তার স্বাস্থ্য, বয়স এবং দেশের ভেতরের ও বাইরের সংকট নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তার উত্তরাধিকার নির্ধারণ প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে গেছে এবং এটিকে ঘিরে অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।

বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো আরাশ আজিজি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘৮৬ বছর বয়সে খামেনি কার্যত শাসনের বাইরে। এখন আর তার হাতে প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত থাকে না, বরং ভবিষ্যতের ক্ষমতা দখলের জন্য লড়াইরত গোষ্ঠীগুলোই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি চলমান এবং বর্তমানের ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ এটিকে আরও ত্বরান্বিত করছে।’

সম্প্রতি এক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ইসরায়েলের খামেনিকে হত্যার পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে ইসরায়েল এখনো এই ধরনের কোনো পরিকল্পনা পুরোপুরি নাকচ করছে না। ইসরায়েলি গোয়েন্দারা ইতোমধ্যে ইরানের বিপ্লবী গার্ডসহ শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের হত্যায় সাফল্য দেখিয়েছে, যা এই সম্ভাবনাকে আরও জোরদার করে।

এদিকে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ইরানের শাসনব্যবস্থা খুবই দুর্বল, এবং জনগণের ৮০ শতাংশ এই ধর্মতান্ত্রিক গোষ্ঠীকে সরিয়ে দিতে চায়।’

ইরানের শীর্ষ নেতা হিসেবে খামেনি সবসময় সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে কৌশলী প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলা ও তেহরানের জবাবদিহিতার অভাব অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে।

কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর সিনিয়র ফেলো করিম সাদ্দাদপুর বলেন, ‘খামেনি এখন স্ব-প্ররোচিত দ্বিধার মধ্যে পড়েছেন। তিনি যে ধরনের উচ্চপ্রযুক্তির যুদ্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি, তার জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি তার নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলের প্রতি দুর্বল প্রতিক্রিয়া তার কর্তৃত্বকে আরও ক্ষয়প্রাপ্ত করবে, আর একটি শক্ত প্রতিক্রিয়া তার পুরো শাসন ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলবে।’

২০২২-২৩ সালে নারী নেতৃত্বাধীন আন্দোলন ছিল ইরানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহগুলোর মধ্যে একটি। হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, কিন্তু কঠোরভাবে তা দমন করা হয়। এরপরেও খামেনির শাসনের প্রতি অসন্তোষ থেমে নেই। তবে বড় কোনো গণবিদ্রোহ এখনো মাথা চাড়া দেয়নি।

বিদেশে অবস্থানরত বিরোধী দলের নেতা ও সাবেক যুবরাজ রেজা পাহলভি ইরানিদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘শক্তিশালী থাকো, আমরা জিতব’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইরানে অভ্যন্তরীণ বিরোধী আন্দোলন এখনো ঐক্যবদ্ধ নয় এবং বিদেশি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়েও সাধারণ মানুষ দ্বিধায় রয়েছে।

ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো হলি ডাগ্রেস বলেন, ‘অনেক ইরানি ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পতন দেখতে চায়। তবে তারা যুদ্ধ বা রক্তপাতের বিনিময়ে সেটা চায় না।’

অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ইরান যখন ওমানে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে নতুন আলোচনায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ইসরায়েলের প্রথম দফার আক্রমণ দেশটির নেতৃত্বকে চমকে দেয়। এই হামলা শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, মনস্তাত্ত্বিকভাবেও ইরানকে এক ধরনের অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দেয়।

মার্কিন-ভিত্তিক নীতি বিশ্লেষক জেসন ব্রডস্কি বলেন, ‘আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সবসময় নিজের কৌশলের জন্য গর্ব করতেন—সংঘাত না করে কৌশলে জয়লাভ। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি বলছে তিনি ভুল গণনা করেছেন।’

শাসন পরিবর্তনের সম্ভাবনা কতটা বাস্তব?

ইসরায়েলি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ইঙ্গিত দিয়েছে সামরিক চাপের মাধ্যমে ইরানের শাসন কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে। তবে আরাশ আজিজি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘এই ধারণার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই যে একটি বিদেশ-চালিত বিদ্রোহের মাধ্যমে ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থা পরিবর্তিত হবে বা নির্বাসিত কাউকে ক্ষমতায় আনা হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা হয়তো ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন ও অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই ঘটবে, যেখানে জনগণের ভূমিকা থাকলেও তা নেতৃত্বে কোনো বড় রদবদলের নিশ্চয়তা দেবে না।’

আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নেতৃত্বে ইরান দীর্ঘদিন ধরে কড়া নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতিতে কৌশলী দূরত্ব ও ঘরোয়া দমননীতির মাধ্যমে টিকে ছিল। কিন্তু বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপ, বয়সজনিত সীমাবদ্ধতা এবং উত্তরাধিকার সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা ইরানের ভবিষ্যতের জন্য এক কঠিন সময় সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা নতুন করে প্রশ্ন তুলছে— ইসলামী প্রজাতন্ত্র কি তার সবচেয়ে অস্থির সময়ের মুখোমুখি?