ইরানের দ্রুত অগ্রসরমান পারমাণবিক কর্মসূচিকে ঘিরে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। সম্প্রতি ইসরায়েল ইরানের একাধিক পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এই হামলার পর দেশটির প্রতিক্রিয়া ও কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।
এদিকে ইসরায়েলি নেতারা বলছেন, ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির হুমকি মোকাবিলা করার জন্য এই হামলা জরুরি ছিল।
তবে ইরান দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে- তাদের এই পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ।
এ বিষয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও মনে করে- তেহরান সক্রিয়ভাবে বোমা তৈরির চেষ্টা করছে না।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইরানে মোট সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ছিল প্রায় ৯ হাজার ২৪৭ দশমিক ৬ কেজি বা ২০১৫ সালের চুক্তিতে নির্ধারিত সীমার চেয়ে ৪৫ গুণ বেশি।
মোট মজুতকৃত ইউরেনিয়ামের মধ্যে ৪০৮ দশমিক ৬ কেজি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করেছে ইরান, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে প্রযোজ্য সমৃদ্ধকরণের চেয়ে সামান্য কম। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ইউরেনিয়াম ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করতে হয়।
নিচে কিছু ইরানের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনার তালিকা দেওয়া হলো:...
১. নাতাঞ্জ
তেহরানের প্রায় ২২০ কিলোমিটার (১৩৫ মাইল) দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত নাতাঞ্জ ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। এই স্থাপনার একটি অংশ সম্ভাব্য বিমান হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য ভূগর্ভস্থ। এখানে একাধিক ক্যাসকেড (সেন্ট্রিফিউজের একটি দল) একসঙ্গে কাজ করে দ্রুত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে।
নাতাঞ্জের দক্ষিণ বেড়ার ঠিক বাইরে অবস্থিত ‘কুহ-ই কোলাং গাজ লা (পিক্যাক্স পর্বত)’-তেও দেশটির পারমাণবিক নিয়ে কাজ করছে। নাতাঞ্জে অতীতে ইসরায়েলি ও আমেরিকানদের তৈরি বলে মনে করা ‘স্টাক্সনেট ভাইরাসের’ আক্রমণ হয়েছিল, যা ইরানি সেন্ট্রিফিউজগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এছাড়াও, ইসরায়েলের জন্য দায়ী দুটি পৃথক নাশকতামূলক হামলাও এই স্থাপনায় আঘাত হেনেছে।
২. ফোর্দো
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ফোর্দো তেহরানের প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬০ মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এটিও সেন্ট্রিফিউজ ক্যাসকেড ধারণ করে, তবে নাতাঞ্জের মতো বড় স্থাপনা নয়। একটি পাহাড়ের নীচে সমাহিত এবং বিমান-বিরোধী ব্যাটারি দ্বারা সুরক্ষিত। এই স্থাপনাটি বিমান হামলা সহ্য করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) এর মতে, এর নির্মাণকাজ ২০০৭ সালে শুরু হয়েছিল। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্র পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পরে ইরান ২০০৯ সালে জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থাকে এই স্থাপনা সম্পর্কে অবহিত করে।
৩. বুশেহর
ইরানের একমাত্র বাণিজ্যিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি তেহরানের প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার (৪৬৫ মাইল) দক্ষিণে পারস্য উপসাগরের বুশেহরে অবস্থিত। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির অধীনে এই স্থাপনার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর, ইরান-ইরাক যুদ্ধে এই কেন্দ্রটি বারবার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। রাশিয়া পরে এই স্থাপনার নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে।
ইরান এই স্থানে এর মতো আরও দুটি চুল্লি তৈরি করছে। বুশেহর ইরানে নয়, ‘রাশিয়াতে উৎপাদিত ইউরেনিয়াম’ দ্বারা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ)-এর দ্বারা তদারকি করা হয়।
৪. আরাক ভারী জল চুল্লি
আরাক ভারী জল চুল্লিটি তেহরানের ২৫০ কিলোমিটার (১৫৫ মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। ভারী পানি পারমাণবিক চুল্লিগুলোকে ঠাণ্ডা করতে সাহায্য করে, কিন্তু এটি একটি উপজাত হিসেবে ‘প্লুটোনিয়াম’ তৈরি করে, যা সম্ভাব্যভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি ইরান অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে এটি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ছাড়াও বোমা তৈরির আরেকটি পথ তৈরি করবে। ২০১৫ সালে বিশ্বশক্তির সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তির অধীনে ইরান পরমাণু বিস্তার সংক্রান্ত উদ্বেগ দূর করার জন্য এই স্থাপনাটি পুনরায় নকশা করার বিষয়ে সম্মত হয়েছিল।
৫. ইসফাহান
তেহরানের প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার (২১৫ মাইল) দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ইসফাহানের এই স্থাপনায় হাজার হাজার পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিযুক্ত আছেন। এটি দেশের পারমাণবিক কর্মসূচির সাথে যুক্ত ‘তিনটি চীনা গবেষণা চুল্লি’ এবং পরীক্ষাগারও রয়েছে।
৬. তেহরান গবেষণা চুল্লি
তেহরান গবেষণা চুল্লিটি ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সদর দপ্তরে অবস্থিত, যা দেশের পারমাণবিক কর্মসূচির তত্ত্বাবধানকারী বেসামরিক সংস্থা। ১৯৬৭ সালে শীতল যুদ্ধের সময় আমেরিকার ‘শান্তির জন্য পরমাণু’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে চুল্লিটি সরবরাহ করেছিল। প্রাথমিকভাবে এর জন্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম প্রয়োজন ছিল কিন্তু পরবর্তীতে প্রসারণ সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে কম সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করার জন্য এটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছিল।