পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলার জবাবে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে ‘শত শত বিভিন্ন ধরনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র’ নিক্ষেপ করেছে ইরান। যা সাম্প্রতিক সময়ে দুদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলা। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ৩০ বছর ধরে বলে আসছেন, ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি।
এই সময়ের মধ্যে অন্তত দুবার তিনি ইরানে হামলা চালানোর প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি হামলা চালাতে পারেননি। তবে এবারে ৭৫ বছর বয়সী ইসরায়েলি এই প্রধানমন্ত্রী তার দেশের ইতিহাসে ইরানের ওপর সবচেয়ে বড় হামলা শুরু করেছেন।
পরমাণু সমৃদ্ধকরণে সফল হলে ইরান ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য ‘হুমকিস্বরূপ’ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করে ইসরায়েল।
হামলার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকেই। মার্কিন গোয়েন্দারা ইরানের পরমাণু সংশ্লিষ্ট স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলার সতর্কতা দিয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই।
তারা বলেছিল, ইরানের পারমাণবিক বোমা বানানোর প্রকল্প নিয়ে বেশ উদ্বেগে আছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ইরানকে এই অস্ত্র তৈরি করা থেকে বিরত রাখতে দেশটিতে সামরিক হামলা চালানো ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প উপায়ে ‘আগ্রহী’ নন তিনি।
ইরানের পরমাণু প্রকল্প ধ্বংস ও ইরানের ইসলামপন্থি সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে ইরানে হামলার পরিকল্পনা করছেন নেতানিয়াহু।
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানের ক্ষমতায় আসে ইসলামপন্থি সরকার, যা ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়। প্রকাশ্যে বিশ্বের মানচিত্র থেকে ইসরায়েলকে মুছে ফেলার লক্ষ্য ঘোষণাও করেছিলেন তৎকালীন সরকার প্রধানেরা।
এ লক্ষ্য পূরণের জন্য ইয়েমেনে হুতি, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহসহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আরও কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী গড়ে তুলেছে ইরান। গোষ্ঠীগুলোর মূল লক্ষ্য ইসরায়েলকে ধ্বংস করা এবং তেহরান নিয়মিত এসব গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে।
দীর্ঘদিন ধরে ইরানের মদদপুষ্ট গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলে চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে আসছিল। তবে গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামাসের অতর্কিত হামলার পর গাজায় যখন সামরিক অভিযান শুরু করে আইডিএফ, সে সময় নতুনভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে হুতি ও হিজবুল্লাহ।
ইরানে সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে ইসরায়েলের পরিচালিত সাম্প্রতিক হামলা ছিল পরিকল্পিত ও নিখুঁত। এ অভিযানে ব্যবহার করা হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি ও গোপন ঘাঁটি। এ ছাড়া ছিল গোয়েন্দা তথ্যের নিখুঁত সমন্বয়। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ‘নিখুঁত’ পরিকল্পনায় হামলা চালিয়ে ইরানের সামরিক সক্ষমতায় আঘাত করা হয়।
ইসরায়েলি বাহিনীর মতে, এই অভিযানের নাম ছিল ‘রাইজিং লায়ন’ (উদীয়মান সিংহ)। ইরানের একাধিক সামরিক লক্ষ্যবস্তু বিশেষ করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও কমান্ড সেন্টারগুলো এ হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল।
একজন ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা জানান, হামলায় অংশ নেওয়া সব পাইলট নিরাপদে ফিরে এসেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা একযোগে হামলা চালিয়ে ইরানের সামরিক সক্ষমতাকে আঘাত করেছি।’
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে দুর্বল করতে ইসরায়েল বহু বছর ধরে সুপরিকল্পিত গোপন অভিযান পরিচালনা করে আসছে। এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বাস্তবায়ন করা হয় তিন ধাপে গঠিত একটি জটিল সামরিক কৌশল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মোসাদ এজেন্টরা তেহরানের আশেপাশে একটি অ্যাটাক ড্রোনঘাঁটি স্থাপন করে। পরে সেখান থেকে গভীর রাতে ড্রোন পাঠিয়ে ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র সাইটে নিশানাভেদী হামলা চালানো হয়। এই ড্রোনঘাঁটির অস্তিত্ব প্রকাশিত হওয়ার পর ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর বিশ্বজুড়ে প্রশ্ন উঠেছে।
দ্বিতীয় ধাপে মোসাদ গোপনে উন্নত অস্ত্র ইরানে প্রবেশ করায়। সেসব অস্ত্রের মধ্যে ছিল সাইবার হামলার যন্ত্র, জ্যামিং ডিভাইস এবং ক্ষুদ্রাকৃতির অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অচল করে দেওয়া হয়, যাতে ইসরায়েলি বিমানগুলো নির্বিঘ্নে আকাশসীমায় প্রবেশ করতে পারে।
তৃতীয় স্তরে মোসাদ কমান্ডোরা মধ্য ইরানে অনুপ্রবেশ করে। তারা ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা সাইটের নিকটে ক্ষুদ্র, কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে, যেগুলো লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে সক্ষম।
এ অপারেশন ইরানের নিরাপত্তা কাঠামোর ফাঁকফোকরকে প্রকাশ করেছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
এদিকে, বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলের হামলা ‘চমৎকার’ ও ‘অত্যন্ত সফল’ বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা সব জানতাম। আমি ইরানকে অপমান ও ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আমি খুব চেষ্টা করেছি। কারণ, আমি চাইতাম, একটা চুক্তি হোক। আমি ইরানকে ৬০ দিন সময় দিয়েছিলাম, আজ ৬১তম দিন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, আমি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে হামলা পিছিয়ে দিতে বলেছিলাম। আমি চেয়েছি কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি (ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সংকট) সমাধান হোক।
যদিও আলোচনায় ব্যর্থ হলে ইরানকে হামলার হুমকিও দিয়েছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে থাকবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, তিনি ইসরায়েলকে সমর্থন করেন। তবে এ হামলার জেরে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে কি না, সে বিষয়ে কিছু বলেননি।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের খুব ঘনিষ্ঠ। আমরা তাদের সবচেয়ে বড় মিত্র,’ ‘দেখা যাক, কী হয়।’
তিনি বলেন, এ হামলা তার কৌশলের অংশ। একদিকে তিনি প্রকাশ্যে সোজাসাপটা কথা বলেন, অন্যদিকে আড়ালে দর-কষাকষি চালিয়ে যান।
আপনার মতামত লিখুন :