ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার সূচনা আকাশপথ ধরে নয়, এর শুরুটা হয়েছিল স্থলপথ ধরে। হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন প্রতিবেদন অন্তত সে রকমই ইঙ্গিত করছে। এই হামলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইসরায়েল। প্রস্তুতির ভিত্তি ছিল গভীর গোয়েন্দা তথ্য ও ইরানে অপারেশনাল অনুপ্রবেশ।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের কর্মকর্তারা সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীতে ইসরায়েলি অনুপ্রবেশের বিষয়ে অবশ্য আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তবে এই পুরো ঘটনায় ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ভূমিকা কতটা ছিল, তা অনুমান করা সহজ নয়। তা ছাড়া ইসরায়েল সাধারণত মোসাদের কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্য করে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে করা হচ্ছে যে ইরানের মাটিতে লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করা এবং এই অভিযানকে পরিচালনা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে মোসাদ।
এতে বলা হয়েছে, কয়েকজন ইসরায়েলি কর্মকর্তার মন্তব্য থেকে এই বিষয়টা স্পষ্ট যে ‘অ্যান্টি সাবমেরিন সিস্টেম’ (সাবমেরিন বিধ্বংসী ব্যবস্থা), ক্ষেপণাস্ত্রের ভান্ডারকে নিশানা করার পাশাপাশি ইরানের কমান্ড সেন্টার এবং সে দেশের অভ্যন্তরে নির্বাচিত ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে একযোগে এবং অত্যন্ত নিখুঁত পদক্ষতিতে হামলা চালানো হয়েছিল। এই ধরনের পরিকল্পিত এবং নিখুঁত হামলা চালানো একমাত্র সে দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমেই সম্ভব।
ইসরায়েলের হামলায় শুধু ইরানের সামরিক ও পরমাণু স্থাপনাকেই নিশানা করা হয়নি, সে দেশে গোয়েন্দা সক্ষমতার ওপরেও মারাত্মকভাবে আঘাত হানা হয়েছে। এর ফলে ইরানের নেতা ও সামরিক কমান্ডারদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিস্ময় দেখা দেয়।
এই পরিস্থিতিতে হামলার পঞ্চম দিনে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক আনুষ্ঠানিক বার্তা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা গোয়েন্দা ঝুঁকি নিয়ে ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন।
জারি করা নোটিশে কর্মকর্তা ও তাদের নিরাপত্তা দলকে মোবাইল ফোন, স্মার্ট ওয়াচ বা ল্যাপটপের মতো নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ডিভাইস ব্যবহার না করার বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়। তবে এই সতর্কবার্তা কিন্তু শুধু কর্তৃপক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সাধারণ মানুষকেও এসব ডিভাইসের ব্যবহার কমিয়ে ফেলার কথা বলা হয়। জনসাধারণকে এই বার্তা পাঠানো কিন্তু শুধু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়াকেই নয়, এই বিষয়েও ইঙ্গিত করে যে ইরানের অভ্যন্তরে সাইবার নিরাপত্তা লঙ্ঘনের আশঙ্কা দ্রুত এবং গভীরভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইসরায়েলি ও পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিষয়টা শুধু ইরানের সংবেদনশীল তথ্য অব্দি পৌঁছানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এই প্রতিবেদনগুলো এও ইঙ্গিত করে যে, ইরানের মাটিতে আক্রমণাত্মক অস্ত্র তৈরি ও মোতায়েনের জন্য একটা সংগঠিত ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলেছিল ইসরায়েল। স্থানীয় এজেন্টদের নেটওয়ার্ক, তাদের জন্য কভার (এজেন্টদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য)-এর জন্য ব্যবস্থা করা, পরিবহন ব্যবস্থা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই গোপন কর্মকাণ্ড দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সামরিকবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘দ্য ওয়ার জোন’ এবং অন্যান্য সূত্রের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ইরাকের মধ্য দিয়ে যাওয়া ট্রাক, বাণিজ্যিক কন্টেনার এবং যাত্রী স্যুটকেসের মধ্যে বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে রেখে ইরানে অল্প অল্প করে সংবেদনশীল ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র সরঞ্জামের চোরাচালান করেছে ইসরায়েল। এই ডিভাইসগুলোর মধ্যে বৈদ্যুতিন ফিউজ, উন্নত ইলেক্ট্রো- অপটিক্যাল ক্যামেরা, লিথিয়াম ব্যাটারি, হালকা ওজনের ইঞ্জিন, জিপিএস-ভিত্তিক গাইডেন্স সিস্টেম এবং সুরক্ষিত যোগাযোগ ডিভাইস অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সমস্ত যন্ত্রাংশ পরে ইরানের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা মোসাদ গোপন ঘাঁটিতে নিয়ে গিয়ে একত্র করে তাকে আক্রমণাত্মক অস্ত্রের আকার দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে গোপন ডেরা তৈরি করেছিল মোসাদের সদস্যরা।
ইরানের বার্তা সংস্থাগুলো আরও জানিয়েছে, তেহরানের কাছে এমনই এক তিনতলা ভবনের সন্ধান পাওয়া গেছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই ভবন ছিল আত্মঘাতী ড্রোন তৈরি ও সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা ঘাঁটি।
দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসরায়েলের গোপন অভিযানের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তারা ইরানের মাটিতে হালকা ওজনের, নির্ভুল ও রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে কাজ করে এমন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এই ধরনের আধুনিক ও বিশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি অস্ত্র কোনো অপারেটরের উপস্থিতি ছাড়াই ইরানের ভেতর থেকে নিক্ষেপ করা যায়। প্রযুক্তিগতভাবে, এটা এমন একটা অভিযান যা ঐতিহ্যগত পদ্ধতিগুলোকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে।
ইরানের ইংরেজি নিউজ চ্যানেল প্রেস টিভি তাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে লিখেছে, ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এমন ধরনের স্পাইক মিসাইল লঞ্চার উদ্ধার করেছে, যেগুলো ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে নিশানা করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এই সিস্টেমগুলো ইন্টারনেট-অটোমেশন এবং রিমোট কন্ট্রোল দ্বারা সজ্জিত ছিল।
ওই নিউজ চ্যানেলের মতে, এই সিস্টেমগুলো পরিচালনা করছিলেন মোসাদের এজেন্টরা।
প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের তরফে চালানো অভিযানের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ইরানের ওপর বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ শুরু করার আগে তাদের (ইরানের) আকাশ প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ককে নিষ্ক্রিয় করতে চালানো সমন্বিত হামলা। এসব কৌশলের মধ্যে ছিল ছোট আত্মঘাতী ড্রোন, ইরানের মাটিতে মোতায়েন করা গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র এবং ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ারের (বৈদ্যুতিন যুদ্ধ) ব্যবহার। এগুলোর সম্মিলিত ব্যবহারের লক্ষ্য ছিল ইরানের রাডার সিস্টেমকে ব্যর্থ করে দেওয়া এবং ডিফেন্স মিসাইল লঞ্চ প্ল্যাটফর্ম (প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ প্ল্যাটফর্ম)-কে ধ্বংস করা যাতে ইসরায়েল ইরানের ওপর হামলা চালানোর জন্য একটা নিরাপদ করিডোর পেয়ে যায়।
সামরিক কর্মকাণ্ডকেন্দ্রিক খবর প্রকাশ করে এমন একটি ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, অভিযানের শুরুতে ছোট এবং হালকা কোয়াডকপ্টারের মতো ড্রোন এবং মাইক্রো-ড্রোনের একটা গ্রুপ একযোগে সক্রিয় করা হয়েছিল। এসব ড্রোন গত কয়েক মাসে ইরানের বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
ইরানে হামলার প্রথম দিনই একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জানায়, মোসাদ কমান্ডোরা ইরানি ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছে এবং ইরানি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চারপাশে নির্ভুল-নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে।
ইসরায়েলি সংবাদপত্র ইয়েদিওথ আহরোনোথ আরও জানিয়েছে, সমন্বিত এসব আক্রমণ কেবল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যই নয়, বরং ইরানের প্রাথমিক উৎক্ষেপণ ক্ষমতা ধ্বংস করার জন্যও তৈরি করা হয়েছিল।
সুতরাং, মনে হচ্ছে ইসরায়েল প্রথমে যুদ্ধবিমান দিয়ে নয়, বরং ইরানের মাটিতে লুকানো ডিভাইস দিয়ে আক্রমণ করেছিল।
ইসরায়েলের অভিযানের আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তারা ইরানের সামরিক বাহিনী ও রেভল্যুশনারি গার্ডের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যবস্থাকে দুর্বল করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিত্বদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নিশানা করেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোসাদ ও তার মিত্র দলগুলো গোপন তথ্য ও স্মার্ট অস্ত্রের সাহায্যে ইরানের কমান্ড সিস্টেম ভাঙার এবং চেন অফ কমান্ড-এ বাধা তৈরির চেষ্টা করে। ইরানের সামরিক প্রস্তুতিকেও ধীরে করে দেয় তারা। অভিযানের শুরুতেই চালানো কয়েকটা হামলায় সামরিক ঘাঁটি বা ক্ষেপণাস্ত্র প্ল্যাটফর্মকে নিশানা করা হয়নি। হামলা চালানো হয়েছিল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাড়িতে বা অফিসে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে আরও বলা হয়েছে, ইরানের মাটি থেকেই স্পাইক মিসাইল লঞ্চার দিয়ে এসব হামলা চালানো হয়েছিল। এই জাতীয় ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে ভবনের ভেতরে থাকা মানুষকেও সরাসরি নিশানা করতে পারে।
প্রাপ্ত প্রমাণে দেখা গেছে, ইসরায়েলের গোয়েন্দা প্রস্তুতি শুধু ইরানে হামলা চালানোর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত চলেনি, তারপরেও জারি থেকেছে। ইরানে হামলা সময় সমান্তরালভাবে সে দেশের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদেরও নিশানা করা হয়। রেভল্যুশনারি গার্ডের গোয়েন্দা শাখার প্রধান মোহাম্মদ কাজমি ও তার ডেপুটিকে হামলার তৃতীয় দিনে নিশানা করা হয়।
একইসঙ্গে শুক্রবার (২০ জুন) এক কমান্ডারের মৃত্যুর পর তার জায়গায় নিযুক্ত হওয়া এক কর্মকর্তাকেও হত্যা করা হয়। ওই পদে নিয়োগের পর মাত্র চার দিন হয়েছিল।
আমেরিকান থিংক ট্যাংক ‘হাডসন ইনস্টিটিউট’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের এই পুরো কৌশল বহু বছরের প্রস্তুতির ফসল, যার মধ্যে রয়েছে ক্রমাগত তথ্য সংগ্রহ, রিয়েল-টাইম মনিটরিং এবং নির্ধারিত লক্ষ্যের একেবারে ভেতরে নির্ভুলভাবে পৌঁছানো।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা।
আপনার মতামত লিখুন :