ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সময় নিরুদ্দেশ থাকার জল্পনা এবং মৃত্যুর গুঞ্জন উড়িয়ে অবশেষে জনসমক্ষে এলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। যুদ্ধবিরতি শুরুর দুই দিন পর বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভিডিও বার্তায় তাকে ইরানের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে দেখা গেছে।
এই বার্তায় খামেনি ইসরায়েলের পাশাপাশি তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেছেন।
ভিডিও বার্তায় খামেনি দাবি করেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ইরান ওয়াশিংটনের গালে ‘সজোরে চপেটাঘা’ করেছে।
গত ১৩ জুন ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুরু হলে প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্র কেবল ইসরায়েলকে সহযোগিতা করে যাচ্ছিল। তবে ২১ জুন ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ওয়াশিংটন সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
এর এক দিন পরই কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায় ইরান। এই হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন।
ইসরায়েলের ‘ধংস’ এবং ইরানের দৃঢ়তা
ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর প্রথম ভিডিও বার্তায় খামেনি বলেন, ‘এই যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করেছিল কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল, তাদের হস্তক্ষেপ ছাড়া ‘জায়নবাদী’ ইসরায়েল ধ্বংস হয়ে যাবে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে ইসরায়েল ‘প্রায় ধসে পড়েছে’ এবং ইরানের হামলায় তারা ‘চূর্ণবিচূর্ণ’ হয়ে গেছে। ৮৬ বছর বয়সী এই নেতা হুঁশিয়ারি দেন যে, ইরানের ওপর হামলার জন্য শত্রুদের চড়া মূল্য দিতে হবে।
খামেনি দৃঢ়ভাবে জানান, ইরান কখনো ‘আত্মসমর্পণ’ করবে না।
পরমাণু স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে জবাব
যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানের ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান—এই তিনটি পরমাণু স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তারও একটি জবাব দেন খামেনি।
তিনি বলেন, ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ছিল নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের জন্য। তাদের বোমা ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আঘাত হেনেছে, তবে খুব বেশি কিছু অর্জন করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র।
খামেনির অবস্থান নিয়ে রহস্য
ভিডিওতে খামেনির পেছনে ছিল একটি বাদামি পর্দা, এক পাশে ইরানের পতাকা এবং অন্য পাশে তার পূর্বসূরি আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনির ছবি।
কোথায় এই ভিডিও ধারণ করা হয়েছে, তা অবশ্য জানা যায়নি।
ইরানিদের স্বস্তি ও সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্বেগ
এতদিন খামেনির অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশায় ছিলেন ইরানের সরকারি কর্মকর্তারাও। খামেনির মহাফেজখানার দপ্তরের কর্মকর্তা মেহদি ফাজায়েলিকে যখন এক টেলিভিশন উপস্থাপক তার সুস্থতা নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তখন তিনি সরাসরি কোনো জবাব দিতে পারেননি, শুধু বলেন, আমাদের সবার দোয়া করা উচিত।
এই ভিডিও বার্তা ইরানিদের জন্য একটি স্বস্তির বিষয়, কারণ তার সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানা না গেলেও অন্তত এটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে যে তিনি জীবিত আছেন।
হত্যার শঙ্কা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
ইরানের সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খামেনি একটি বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন এবং ইলেকট্রনিক যোগাযোগব্যবস্থা থেকে তাকে বিরত রাখা হয়েছে।
তিনি হত্যার শিকার হতে পারেন—এমন আশঙ্কা থেকে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ইরানের পত্রিকা ‘খানেমান’-এর সম্পাদক মোহসেন খালিফেহ জানান, এই অনুপস্থিতির কারণে আর সবার মতো তিনিও খামেনির মৃত্যু নিয়ে ভয় পেয়েছিলেন।
খামেনি ইরানের সব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে থাকেন। তার আড়ালে থাকার সময় মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা ও যুদ্ধবিরতির মতো গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তেহরানকে।
এই সিদ্ধান্তগুলো কে নিয়েছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ইরানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামজেদ সাফাভি বলেন, দূর থেকেই প্রধান প্রধান সিদ্ধান্ত খামেনি এখনো নিচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি।
সাফাভি আরও বলেন, যুদ্ধবিরতি চলাকালেও ইসরায়েল খামেনিকে হত্যার চেষ্টা করতে পারে বলে ইরানের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মনে করছেন।
এ কারণে সর্বোচ্চ নেতাকে ঘিরে চরম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং বাইরের জগতের সঙ্গে খামেনির যোগাযোগ কমানো হয়েছে।
এমন সংকটের মধ্যে দেশ চালানোর জন্য প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানসহ অন্য নেতাদেরও ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস
আপনার মতামত লিখুন :