জোহানেসবার্গ শহরের একটি ক্লিনিক থেকে এইচআইভি চিকিৎসার ওষুধ সংগ্রহ করতেন গুগু। ক্লিনিকটি মার্কিন সরকারের সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডি-এর অর্থায়নে চলত। কিন্তু এ বছরের শুরুতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিদেশে সহায়তা কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে গুগুসহ দক্ষিণ আফ্রিকার হাজার হাজার এইচআইভি পজিটিভ রোগীর জীবন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
গুগু (ছদ্মনাম) সৌভাগ্যবান ছিলেন, কারণ তিনি যে ক্লিনিক থেকে ওষুধ নিতেন সেটি বন্ধ হওয়ার আগেই তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমি সাধারণত তিন মাসের ওষুধ একসঙ্গে নিই। কিন্তু ক্লিনিক বন্ধ হওয়ার আগে তারা আমাকে নয় মাসের ওষুধ দিয়ে দিয়েছিল।’
এই ওষুধ সেপ্টেম্বর মাসে শেষ হয়ে যাবে, এরপর তিনি স্থানীয় একটি সরকারি হাসপাতালে গিয়ে নতুন করে চিকিৎসা নেবেন বলে জানান। ৫৪ বছর বয়সি গুগু এক সময় যৌনকর্মে জড়িত ছিলেন। সেই জীবন ছেড়ে দেওয়ার কিছুদিন পর তিনি জানতে পারেন, তিনি এইচআইভি পজিটিভ।
১০ বছর আগে একবার তার বুকে কাশি দেখা দেয়। তিনি ভেবেছিলেন এটি যক্ষ্মা। তখন একজন ডাক্তার তাকে জানান, তার ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছে এবং সে অনুযায়ী তার চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু মোটেও সুস্থ না হওয়ায় এইচআইভি পরীক্ষা করাতে একটি ক্লিনিকে যান।
তিনি বলেন, ‘তখন আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে আমি এইচআইভি পজিটিভ এবং আমি নার্সকে এটা বলেছিলাম।’
গুগু ঠিকই বলেছিলেন, তাকে যখন প্রথম বলা হয় তিনি এইচআইভি পজিটিভ, তখন থেকেই তিনি অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ খেতে শুরু করেন। এখন তিনি একটি বেসরকারি এনজিওতে প্রকল্প সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা গর্ভবতী যৌনকর্মীদের ওষুধ পেতে সাহায্য করি, যেন তাদের সন্তানরা এইচআইভি-নেগেটিভ হয়ে জন্মাতে পারে। সময়মতো ওষুধ খাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে আমরা মায়েদের বাসায় যাই এবং চেকআপের সময় বাচ্চাদের খেয়াল রাখি।’
দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক এইচআইভি-পজিটিভ যৌনকর্মী আগে ইউএসএআইডি অর্থায়িত ক্লিনিকে চিকিৎসা পেতেন। কিন্তু এ বছরের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিদেশি সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এসব ক্লিনিকের অনেকগুলোই বন্ধ হয়ে যায়।
গুগু মনে করেন, যদি যৌনকর্মীরা তাদের ওষুধ আগের মতো ক্লিনিক থেকে না পান তাহলে তারা অনেকেই সরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে অনিচ্ছুক হতে পারেন। এতে তাদের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, যা তাদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিপজ্জনক।
তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সময়। ওখানে ওষুধ পেতে হলে ভোর ৪টা বা ৫টায় গিয়ে লাইন ধরতে হয়, আর তারপর পুরো দিন অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু যৌনকর্মীদের সময়ই তাদের জীবিকা। সময় মানে তাদের জন্য টাকা।’
সম্প্রতি তিনি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে স্থানীয় হাসপাতালে যান নিজের তথ্য নিবন্ধন করতে এবং কর্মীদের সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে। কিন্তু অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো ছিল না। তিনি বলেন, ‘যে নার্স আমাদের সেবা করছিলেন তিনি খুবই রুক্ষ ব্যবহার করছিলেন। আমাদের বলেছিলেন, যৌনকর্মীদের মধ্যে বিশেষ কিছু নেই।’
গুগু মনে করেন, এ ধরনের ব্যবহার অনেক যৌনকর্মীকে নিয়মিত চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে। তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে হাসপাতালের ফাইলে আমাদের অনেক ব্যক্তিগত তথ্য থাকে। আর এসব তথ্য নিয়ে সবসময় ক্লিনিকের নার্সরা খুব সচেতন বা সংবেদনশীল হন না, সেটাই উদ্বেগের বিষয়।’
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন বলেছে, এইচআইভি বা এইডস মোকাবিলায় অনেক দাতা দেশ (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র) অর্থ সহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় বিশ্বের নানা প্রান্তে অসাধারণ অগ্রগতি থেমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
জাতিসংঘের এইডস কর্মসূচি (ইউএনএইডস) জানিয়েছে, ‘২০১০ সাল থেকে নতুন এইচআইভি সংক্রমণ ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, ২০০০ সাল থেকে ৪৪ লাখ শিশুকে এইচআইভি সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা হয়েছে। ২ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি জীবন রক্ষা করা হয়েছে।’

তবে তারা সতর্ক করেছে, যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে ২০২৯ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ৬ লাখ নতুন সংক্রমণ এবং ৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। তারা আরও জানায়, তহবিল কাটছাঁটের আগে গত ৩০ বছরের মধ্যে সংক্রমণ ও মৃত্যু সর্বনিম্ন ছিল।
বিশেষ করে সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চল সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে। সেখানকার নতুন সংক্রমণ ৫৬ শতাংশ কমেছে, যদিও গত বছর এই অঞ্চলে বিশ্বের অর্ধেক নতুন সংক্রমণ ঘটেছে। তবে কিছু দেশ লেসোথো, মালাউই, রুয়ান্ডা ও জিম্বাবুয়ে ২০২০ সালের মধ্যে ২০১০ সালের তুলনায় সংক্রমণ ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনার পথে এগোচ্ছে।
আরেকটি বড় সফলতা হলো অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধের কার্যকারিতা। এগুলোর কারণে এইচআইভি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির ফলে সাব-সাহারান আফ্রিকায় গড় আয়ু ২০১০ সালের ৫৬ বছর থেকে ২০২৪ সালে বেড়ে ৬২ বছরে পৌঁছেছে।
এই পুরো অগ্রগতির পেছনে বড় অবদান রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বুশের সময় শুরু হওয়া ‘পেপফার’ (PEPFAR) নামের একটি উদ্যোগ। এই কর্মসূচির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ বিনিয়োগ করে, যা এককভাবে কোনো এক রোগ মোকাবিলায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় সহায়তা।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশ বলেছিলেন, এই উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের ‘নৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ’ পূরণ করবে।
ইউএনএইডস অনুসারে, দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রায় ৭৭ লাখ মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যা। তাদের মধ্যে প্রায় ৫৯ লাখ রোগী অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল চিকিৎসা গ্রহণ করে, যার ফলে ২০১০ সাল থেকে এইডস-সম্পর্কিত মৃত্যুর হার ৬৬ শতাংশ কমেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার জানিয়েছে, পেপফারের তহবিল তাদের এইচআইভি বা এইডস কর্মসূচিতে প্রায় ১৭ শতাংশ অবদান রেখেছে। রোগীদের চিকিৎসা সহজতর করতে ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক পরিচালনাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে এই অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের কর হ্রাসের ফলে সংক্রমণের হার আবারও বাড়তে পারে বলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
জোহানেসবার্গের উইটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক লিন মরিস বিবিসিকে বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমরা এখন থেকে এইচআইভি, যক্ষ্মা (টিবি) ও অন্যান্য সংক্রামক রোগের সংক্রমণ বাড়তে দেখতে পাব। আমরা এতদিন ধরে যে সাফল্যের পথে এগোচ্ছিলাম, এখন তার উল্টো চিত্র দেখতে শুরু করব। অনেক কিছুরই উন্নতি হচ্ছিল, কিন্তু এখন আবার পিছিয়ে যেতে পারি।’
এই কাটছাঁটের কারণে এইচআইভি ভ্যাকসিন ও এইডসের নিরাময়ের লক্ষ্যে পরিচালিত গবেষণাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অধ্যাপক মরিস আরও বলেন, ‘এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে। মানে আমরা হয়তো ভবিষ্যতে এইচআইভির নতুন কোনো টিকা তৈরি করতে পারব না। ভাইরাসগুলো কীভাবে ছড়াচ্ছে, সেটার ওপর নিয়মিত নজর রাখা সম্ভব হবে না। এমনকি যদি নতুন কোনো ভাইরাসের জন্মও হয়, তবুও আমরা হয়তো আর আগের মতো পর্যবেক্ষণ ও সতর্কতার ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে পারব না।’
এইচআইভি গবেষণায় দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে একটি। ভাইরাস প্রতিরোধে সহায়তা করে ও বিশ্বজুড়ে মানুষের উপকারে এসেছে এমন অনেক ওষুধ দক্ষিণ আফ্রিকায় পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রেপ (প্রি-এক্সপোজার প্রফিল্যাক্সিস) ওষুধ এইচআইভি-নেগেটিভ ব্যক্তিদের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া বন্ধ করে।
চলতি বছর একটি নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক ওষুধ লেনাকাপাভির চালু হয়েছে, যা বছরে মাত্র দুবার খেতে হয় এবং এটি এইচআইভি থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেয়। এই ওষুধটি দক্ষিণ আফ্রিকায় পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
উইটস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ক্যাম্পাসের একটি ল্যাবে কিছু বিজ্ঞানী এখনো এইচআইভির একটি টিকা তৈরি নিয়ে কাজ করছেন। তারা ‘ব্রিলিয়ান্ট কনসোর্টিয়াম’ নামের একটি দলের অংশ, যারা আটটি আফ্রিকান দেশে একসঙ্গে কাজ করে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা তৈরির চেষ্টা করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ এলি বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা একটা টিকার প্রাথমিক পরীক্ষা তৈরি করছিলাম দেখার জন্য যে এটি কতটা কার্যকর, তারপর সেটি মানুষের ওপর প্রয়োগ করে পরীক্ষা করা হবে।’
কিন্তু মার্কিন তহবিল হ্রাস তাদের কাজকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। বছরের শেষেই নির্ধারিত ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলো পরিচালনার জন্য ল্যাবটি তহবিলের সংকটে পড়বে।
গত জুন মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় মার্কিন সহায়তার ঘাটতি পূরণ করতে সরকারের কাছে আগামী তিন বছরে ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন র্যান্ড (২৬০ মিলিয়ন ডলার) অর্থ সহায়তার আবেদন করেছে।
ইউনিভার্সিটিস সাউথ আফ্রিকার প্রধান ড. ফেথিওয়ে মাতুতু বলেন, ‘আমরা সরকারের সহযোগিতা চাইছি, কারণ দক্ষিণ আফ্রিকা এইচআইভি গবেষণায় বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কিন্তু এই নেতৃত্ব শুধু নিজেদের জন্য নয়, এর প্রভাব সারা বিশ্বের স্বাস্থ্যনীতি ও চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর পড়ে।’
দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী অ্যারন মোটসোয়ালেদি বুধবার জানান, গবেষণার জন্য কিছু বিকল্প উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।
তিনি জানান, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও ওয়েলকাম ট্রাস্ট তাৎক্ষণিকভাবে ১০০ মিলিয়ন র্যান্ড অনুদান দিতে সম্মত হয়েছে, যেখানে সরকার আগামী তিন বছরে ৪০০ মিলিয়ন র্যান্ড দেবে। ফলে মোট পরিমাণ ৬০০ মিলিয়ন র্যান্ডে পৌঁছাবে, যা গবেষকদের অনুরোধকৃত ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন র্যান্ডের চেয়ে অনেক কম।
আপনার মতামত লিখুন :