সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় সুওয়াইদা প্রদেশে ইসরায়েলের ধারাবাহিক বিমান হামলায় অন্তত তিনজন নিহত এবং ৩৪ জন আহত হয়েছে।
তেল আবিবের দাবি, এই হামলা সিরিয়ার ড্রুজ সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য চালানো হয়েছে। তবে সিরিয়ার সরকার এটিকে ‘প্রকাশ্য আগ্রাসন’ এবং ‘দেশকে অস্থিতিশীল করার একটি ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টা’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী, হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল মধ্য দামেস্কে রাষ্ট্রপতি প্রাসাদের নিকটবর্তী এলাকা এবং সুওয়াইদায় সামরিক স্থাপনাসমূহ। কয়েকদিন ধরে ঐ অঞ্চলে ড্রুজ যোদ্ধা, বেদুইন উপজাতি ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে চলমান সংঘর্ষে ইতোমধ্যে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
কারা ড্রুজ?
ড্রুজরা হল একটি আরবিভাষী জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, যাদের মূল জনসংখ্যা সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল ও ইসরায়েল-অধিকৃত গোলান হাইটস এলাকায় বসবাস করে। তাদের ধর্ম শিয়া ইসলামের ইসমাইলি শাখা থেকে উদ্ভূত হলেও এতে গ্রীক দর্শন, গ্নস্টিকিজম এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক ধারা যুক্ত হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ লাখ ড্রুজের অর্ধেকই সিরিয়ায় বাস করে, যেখানে তারা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ। ইসরায়েলে ড্রুজদের সংখ্যা প্রায় ১.৫ লাখ, যাদের অনেকেই দেশটির সেনাবাহিনীতে কর্মরত এবং রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত হিসেবে বিবেচিত।
সিরিয়ায় ড্রুজরা মূলত সুওয়াইদা প্রদেশে কেন্দ্রীভূত। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের সময় তারা স্থানীয় মিলিশিয়া গঠন করে এবং সরকারি বাহিনীর সঙ্গে অংশগ্রহণে সাধারণত বিরত থাকে।
সংঘর্ষের সূচনা কীভাবে?
গত ১৩ জুলাই সুওয়াইদায় একজন ড্রুজ ব্যবসায়ী অপহরণ হওয়ার পর ড্রুজ যোদ্ধা ও সুন্নি বেদুইন উপজাতিদের মধ্যে প্রতিশোধমূলক সহিংসতা শুরু হয়। এরপর সিরিয়ার সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে, কিন্তু তাদের উপস্থিতিই সংঘর্ষ আরও ঘনীভূত করে তোলে। ড্রুজ সম্প্রদায় সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ এনেছে।
এরপর বেসামরিক এলাকায় সরকারি বাহিনী ও মিলিশিয়াদের অভিযানে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল ১৫ জুলাই সামরিক হস্তক্ষেপ করে, দাবি করেছিল ‘প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ।’
কেন ইসরায়েল এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে?
দক্ষিণ সিরিয়ায় ইসরায়েলের আগ্রহ দীর্ঘদিনের। ১৯৬৭ সালে দখলকৃত গোলান হাইটসে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তারা মাউন্ট হারমনের দক্ষিণ ঢাল পর্যন্ত বিস্তার করেছে। ইসরায়েল সরকার ২০২৭ সালের মধ্যে গোলান হাইটস অঞ্চলে বসতি স্থাপনকারী ইহুদি জনসংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
এর আগে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদ পদত্যাগ করার পর ইসরায়েল সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের সামরিক উপস্থিতি আরও জোরদার করে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বকে তারা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি।
ইসরায়েল এর আগেও সিরিয়ায় বারবার বিমান হামলা চালিয়েছে, যার লক্ষ্য ছিল ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া ও সিরিয়ার সরকারি বাহিনী।
সর্বশেষ হামলার পর ইসরায়েল হুঁশিয়ারি দিয়েছে- সিরিয়ার বাহিনী সুওয়াইদা থেকে প্রত্যাহার না করলে তারা আরও কঠোর পদক্ষেপ নেবে।
মাজদাল শামসে রকেট হামলা ও যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা
গত ২৭ জুন ইসরায়েল-অধিকৃত গোলান হাইটসের ড্রুজ শহর মাজদাল শামসে একটি রকেট হামলায় ১২ জন নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই শিশু। ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে এই হামলার জন্য দায়ী করলেও, গোষ্ঠীটি দায় স্বীকার করেনি।
এদিকে সিরিয়ার সেনাবাহিনী সুওয়াইদা থেকে আংশিক সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে, যা একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ চেকপয়েন্ট ও সামরিক অবস্থানে তাদের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকবে।