দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের একটি বিশেষ রেস্তোরাঁ ‘ওয়ার্ম-হার্টেড কনভেনিয়েন্স স্টোর’। নাম শুনে মনে হতে পারে এটি একটি সাধারণ মুদি দোকান, তবে এটি ভিন্ন একটি সামাজিক উদ্যোগ যেখানে শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়, বরং স্নেহ, ভালোবাসা, সঙ্গ ও সহানুভূতির পরিবেশও পাওয়া যায়।
২৯ বছর বয়সী হি-কিয়ং নিয়মিত এখানে এসে বিনামূল্যে ইনস্ট্যান্ট রামেন নুডলস খান এবং অন্য দর্শনার্থী ও সমাজকর্মীদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটান। তার মতো অনেক নিঃসঙ্গ মানুষের কাছে এই দোকান ‘উষ্ণ হৃদয়ের খোঁজের জায়গা’ হিসেবে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার গত মার্চ থেকে চারটি এ ধরনের দোকান চালু করেছে। সিউলের ডংদেমুন এলাকায় অবস্থিত এই শাখায় প্রতিদিন গড়ে ৭০ থেকে ৮০ জন মানুষ আসেন, যার অধিকাংশই চল্লিশোর্ধ্ব বা পঞ্চাশোর্ধ্ব হলেও তরুণরাও এখানে সময় কাটান।
২০২২ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সিউলের ১৯ থেকে ৩৯ বছর বয়সী প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার তরুণ সামাজিকভাবে একাকী বা স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী। একই সময়ে রাজধানীতে একক সদস্যের পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে। এ কারণে বিয়ে ও জন্মহার কমে যাওয়া সরকারের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘নিঃসঙ্গতা প্রতিরোধ বিভাগ’-এর ম্যানেজার কিম সে-হন জানান, দোকানে নিয়মিত ‘সিনেমা ডে’ আয়োজন করা হয়, যা মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক গড়তে সাহায্য করে। দোকানগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে পরিবার বা ক্যাফের মতো উষ্ণ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশ পাওয়া যায়।
দোকানের এক প্রবীণ নারী স্বয়ংক্রিয় ম্যাসাজ চেয়ারে বিশ্রাম নিচ্ছেন, আর পাশেই স্তূপ করা রয়েছে নুডলস। ম্যানেজার কিম বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়ায় রামেন নুডলস ‘স্বস্তি ও উষ্ণতার’ প্রতীক।’
দোকানে আসা নিঃসঙ্গরা তাদের মনের অবস্থা ও জীবনযাপনের শর্ত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত জরিপ ফরমও পূরণ করেন, যা সামাজিক সংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।
দক্ষিণ কোরিয়ার দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে কৃষিভিত্তিক বড় পরিবার থেকে ছোট ও একক সদস্যের পরিবারে রূপান্তর ঘটে গেছে। বাড়তি বাড়িভাড়া, উচ্চ মূল্যমান এবং কঠোর কর্মঘণ্টার কারণে তরুণরা বিয়ে ও সন্তান ধারণে আগ্রহ হারাচ্ছেন। অন্যদিকে, বৃদ্ধ প্রজন্মের অনেকেই একাকী জীবনযাপন করছেন।
দোকানের কাউন্সেলর লি ইন-সুক বলেন, ‘একাকারে খাবার খাওয়া জীবনের সবচেয়ে নীরস অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি। আমি নিয়মিত প্রবীণদের খাওয়া-দাওয়ার খোঁজখবর নিই এবং তাদের সঙ্গে কথা বলি।’
হি-কিয়ংয়ের মতো অনেক তরুণ প্রথমে নীরব থাকলেও পরবর্তীতে এই জায়গাকে মানসিক শান্তির আশ্রয় মনে করতে শুরু করেন।
নিঃসঙ্গ মৃত্যুর সংখ্যার বাড়তে থাকা সিউল কর্তৃপক্ষকে সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে বাধ্য করেছে। ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্য নিঃসঙ্গতা বিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ দেয় এবং জাপানও একই পথে এগিয়েছে।
সিউলের ‘নিঃসঙ্গতা প্রতিরোধ কর্মসূচি’র ব্যবস্থাপক লি ইউ-জিয়ং বলেন, ‘মহামারির পর নিঃসঙ্গতা বেড়েছে। প্রযুক্তির প্রভাবে আজকের মানুষ বন্ধুত্ব গড়াকে কঠিন মনে করছে।’
দক্ষিণ কোরিয়া একটি হটলাইন চালু করেছে, যেখানে কাউন্সেলররা বিশেষত তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে প্রায় ৪০ মিনিট কথোপকথন করেন।
‘ওয়ার্ম-হার্টেড কনভেনিয়েন্স স্টোর’ নিঃসঙ্গদের মনের কথা প্রকাশের জায়গা করে দিয়েছে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক।
দোকান ব্যবস্থাপক লি বো-হিউন বলেন, ‘এই স্থানগুলো কেবল আড্ডা বা সিনেমা দেখার জায়গা নয়, বরং নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য বিনামূল্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশও প্রদান করে।’
প্রথমদিকে দর্শনার্থীরা কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করলেও এখন অনেকেই নিয়মিত আসেন।
হি-কিয়ং ও কাউন্সেলর ইন-সুকের গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের গল্প মানবিক এক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :