যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন । শুক্রবার (১৫ আগস্ট) আলাস্কার এলমেনডর্ফ রিচার্ডসন ঘাঁটিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই আলোচনায় দুই নেতা ভিন্ন অগ্রাধিকার নিয়ে হাজির হলেও মূল এজেন্ডা থাকবে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, পুতিন বহুদিন ধরেই ইউক্রেনের দখলকৃত এলাকা ধরে রাখার অবস্থানে অটল। অন্যদিকে ট্রাম্প খোলাখুলিভাবেই নিজেকে বৈশ্বিক শান্তিদূত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান।
তবে বৈঠক থেকে উভয়েরই ভিন্নধর্মী কিছু সুযোগ পাওয়ার আশা রয়েছে— যেমন পুতিনের জন্য কূটনৈতিকভাবে পুনর্বাসন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। অন্যদিকে ট্রাম্পের লক্ষ্য অনুমান করা কঠিন, কারণ রুশ প্রেসিডেন্টকে নিয়ে তার সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো পরস্পরবিরোধী।
পুতিনের লক্ষ্য: আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বিজয়
প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রথমেই যা পেয়েছেন, তা হলো স্বীকৃতি— বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এই বার্তা যে, তাকে বিচ্ছিন্ন করার পশ্চিমা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বৈঠক আয়োজন এবং যৌথ সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা ক্রেমলিনের কাছে প্রমাণ দিচ্ছে, রাশিয়া আবারও বৈশ্বিক রাজনীতির শীর্ষ টেবিলে ফিরেছে।
আলাস্কা বেছে নেওয়ার পেছনে ক্রেমলিনের নানা কারণ আছে— প্রথমত, নিরাপত্তা; আলাস্কার মূল ভূখণ্ড রাশিয়ার চুকোটকা থেকে মাত্র ৯০ কিলোমিটার দূরে, যা শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলো এড়িয়ে ভ্রমণের সুযোগ দেয়। দ্বিতীয়ত, এটি ইউক্রেন ও ইউরোপ থেকে অনেক দূরে, যা কিয়েভ ও ইইউ নেতাদের পাশ কাটিয়ে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার কৌশলের সঙ্গে মানানসই।
এখানে ঐতিহাসিক প্রতীকও আছে— ঊনবিংশ শতকে জারশাসিত রাশিয়া আলাস্কা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করেছিল। মস্কো এখন সেটিকে সীমান্ত পরিবর্তন ও ভূখণ্ড দখলের যৌক্তিকতা হিসেবে ব্যবহার করছে।
তবে পুতিন শুধু স্বীকৃতি বা প্রতীকে সন্তুষ্ট নন। তিনি চান চারটি দখলকৃত ইউক্রেনীয় অঞ্চল (দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন) পুরোটাই রাশিয়ার হাতে রাখতে এবং কিয়েভ সেসব এলাকার অবশিষ্ট অংশ থেকেও সরে যাক।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এ শর্ত সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ক্রেমলিনের হিসাব, ট্রাম্প যদি এই দাবিকে সমর্থন করেন, তবে কিয়েভের অস্বীকৃতির পর যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাদের সহায়তা বন্ধ করবে । আর সেই সুযোগে মস্কো-ওয়াশিংটনের সম্পর্ক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা শুরু হবে।
অন্যদিকে, রাশিয়ার অর্থনীতি চাপের মুখে আছে। দেশটিতে বাজেট ঘাটতি বাড়ছে, তেল-গ্যাস রপ্তানি থেকে আয় কমছে। যদি এ পরিস্থিতি পুতিনকে যুদ্ধ শেষ করতে বাধ্য করে, তবে তিনি কিছুটা সমঝোতায় আসতে পারেন। যদিও আপাতত মস্কো যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের এগিয়ে থাকার দাবি করছে।
ট্রাম্পের লক্ষ্য: শান্তি প্রক্রিয়ায় কৃতিত্ব
২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করা সহজ হবে এবং তিনি ২৪ ঘন্টার মধ্যে তা করতে পারবেন। হোয়াইট হাউসে ফেরার পর থেকে তিনি কখনো ইউক্রেন, কখনো রাশিয়ার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এরপর ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে নাটকীয় বৈঠকে তিনি জেলেনস্কিকে তিরস্কার করেন এবং পরে সামরিক সহায়তা ও গোয়েন্দা তথ্য সাময়িকভাবে স্থগিত রাখেন।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিনি আবাসিক এলাকাগুলোতে রাশিয়ার হামলার সমালোচনা করেছেন এবং রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন, যদিও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর করেননি।
এখন তিনি আলাস্কায় বৈঠকে “ল্যান্ড-সোয়াপিং” বা শান্তির বিনিময়ে ভূখণ্ড ছাড়ের প্রস্তাব তুলেছেন, যা কিয়েভের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
বৈঠককে ট্রাম্প কখনো “শুনানি সেশন” বা ট্রাম্পের কথা শোনার বিষয় বলে উল্লেখ করছেন, আবার কখনো বলছেন তিনি দুই মিনিটের মধ্যেই বুঝে যাবেন চুক্তি সম্ভব কি না। কখনো সম্ভাবনা কমিয়ে দিচ্ছেন, আবার মাঝপথে তা বাড়িয়েও দিচ্ছেন। সবশেষ গতকাল পুতিনের সাথে আলোচনা ২৫ শতাংশ ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি পুতিন তার কথা রাখবেন বলে আশাবাদও ব্যক্ত করেন একই সময়।
ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতারা বৈঠকের আগে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেছেন, যাতে তিনি কিয়েভের কাছে অগ্রহণযোগ্য কোনো চুক্তি না করেন। তবু বছরজুড়ে একটি বিষয় স্পষ্ট— ট্রাম্প চান তিনি যেন যুদ্ধের অবসান ঘটানো নেতা হিসেবে পরিচিত হন। উদ্বোধনী ভাষণে তিনি গর্বিত উত্তরাধিকার হিসেবে “শান্তিদূতের” পরিচয় দিতে চেয়েছিলেন এবং নোবেল শান্তি পুরস্কারের আকাঙ্ক্ষাও লুকাননি।
এমন অবস্থায় বৃহস্পতিবার ওভাল অফিসে ট্রাম্প তার শাসনামলে সমাধান হওয়া বৈশ্বিক সংঘাতের কথা বলেন, তবে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে স্বীকার করেন, “আমি ভেবেছিলাম এটিই সবচেয়ে সহজ হবে, আসলে এটি সবচেয়ে কঠিন।”
যদি বৈঠক শেষে তিনি শান্তি প্রক্রিয়ায় অগ্রগতির দাবি করার সুযোগ পান, তবে তা অবশ্যই নেবেন— আর পুতিন হয়তো তা ঘটতে দেবেন, তবে রাশিয়ার শর্তে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন