আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ভারতের মধ্যপ্রদেশের একটি ছোট শহরে সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে কোনওরকম ব্যাখ্যা ছাড়াই শিশুমৃত্যুর ঘটনা স্বাস্থ্যকর্মীদের বিচলিত করে তুলেছিল। সাধারণ কাশির সিরাপ সেবনের কয়েকদিনের মধ্যেই কমপক্ষে ১১টি শিশুর মৃত্যু হয়েছিল ওই শহরে। এদের বয়স ছিল এক থেকে ছয় বছরের মধ্যে।
ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে পানীয় জল পরীক্ষা থেকে শুরু করে এরজন্য মশা দায়ী কি না- সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখেছিলেন কর্মকর্তারা। তারপর জানা যায় ওই শিশুদের কিডনি ফেল করেছিল। এর কয়েক সপ্তাহ পরে, ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর চেন্নাইয়ের একটি রাষ্ট্রীয় পরীক্ষাগার যে বিষয়টি নিশ্চিত করে তা আরও ভয়াবহ।
প্রশ্নের মুখে থাকা কাশির সিরাপটিতে ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ ডাইথাইলিন গ্লাইকোল রয়েছে। এটি একটি বিষাক্ত ইন্ডাস্ট্রিয়াল দ্রাবক যা কখনোই ওষুধে থাকা উচিত নয়। এটি সেবনের পর কিডনি ফেল হওয়ার ঘটনা অস্বাভাবিক নয়।
এই ভয়াবহ ঘটনা শুধুমাত্র মধ্যপ্রদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। পার্শ্ববর্তী রাজ্য রাজস্থানে, স্থানীয়ভাবে তৈরি ডেক্সট্রোমেথোরফান সিরাপ সেবনের পরে দু'জন শিশুর মৃত্যু হয়। কাশি প্রশমনের জন্য ব্যবহৃত ওই সিরাপ কিন্তু ছোট বাচ্চাদের জন্য একেবারেই নিরাপদ নয়। শিশু মৃত্যুর ঘটনা মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং বিষয়টি নিয়ে সরকারি তদন্ত শুরু হয়।
এই ঘটনা যেন ভারতে অতীতের ভয়াবহ স্মৃতিকে আবার ফিরিয়ে আনে। বছরের পর বছর ধরে ভারতে তৈরি কাশির সিরাপগুলিতে ডাইথিলিন গ্লাইকোলের উপস্থিতি বহু শিশুর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০২৩ গাম্বিয়ায় ৭০ জন এবং উজবেকিস্তানে ১৮টি শিশুর মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে ডাইথিলিন গ্লাইকোল যুক্ত ভারতীয় সিরাপগুলির যোগ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
পাশাপাশি, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত শাসিত কাশ্মীরের জম্মুতে পাঁচ বছরের নিচে কমপক্ষে ১২টি শিশুর মৃত্যুর নেপথ্যে ছিল কাশির সিরাপ। তবে আক্টিভিস্টদের মতে ভুক্তভুগীদের সংখ্যা কিন্তু আরও বেশি।
অতীতে, কোডিনযুক্ত কাশির সিরাপগুলোর অপব্যবহারও হয়েছে। কোডিন অল্পমাত্রার ওপিওয়েড (যন্ত্রণার কষ্ট কমাতে ব্যবহার করা হয় ওপিওয়েড যা ব্যবহার করলে আছন্ন লাগে) যা উচ্চ মাত্রায় আবেগ তৈরি করতে পারে। এর প্রতি আসক্তি তৈরি হওয়ারও সম্ভাবনা দেখা যায়। ছোট বাচ্চাদের জন্য এই জাতীয় কাশির সিরাপ দেওয়া উচিত নয়।
নিয়ন্ত্রকরা প্রতিবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও দূষিত কাশির সিরাপগুলো বাজারে আবার হাজির হয়, যা প্রমাণ করে যে ওষুধের বাজারের পরিস্থিতি আসলে কী। সমালোচকদের অভিযোগ, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে প্রায়শই অঅনুমোদিত সিরাপগুলো ছোট নির্মাতারা কম খরচে এটি উৎপাদন করে। শুধু তাই নয় এগুলি ওষুধের দোকানে বিক্রিও করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে, শিশু মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ্যে আসার কয়েকদিন পরে, ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই জাতীয় ওষুধের ‘যৌক্তিক’ ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে। পাশাওয়াশি ছোট বাচ্চাদের প্রেস্ক্রাইব করার সময় আরও সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য ডাক্তারদের নির্দেশ দিয়েছে। সিরাপের নমুনা বাজেয়াপ্ত করা ছাড়াও তার বিক্রয় স্থগিত এবং নিষিদ্ধ করেছে। ঘটনাটি নিয়ে তদন্তেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে সমালোচকরা মনে করেন এই সমস্যাটি শুধুমাত্র প্রেসক্রিপশনে কাশির সিরাপের উল্লেখ করার চেয়েও অনেক বেশি গভীর। প্রতিটি ঘটনা প্রমাণ করে ভারতে ওষুধ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনায় কীভাবে ঘুণ ধরেছে। আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এর জন্য দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।
মার্কেট রিসার্চ ফিউচার নামক সংস্থার তথ্য অনুসারে, ভারতীয় কাশির সিরাপের বাজার ২০২৪ সালে ২৬২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০৩৫ সালের মধ্যে ৭৪৩ মিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ ৯ দশমিক ৯ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এর কিছুই ঘটবে না যদি ভারত এবং ভারতীয়রা কাশির সিরাপের প্রতি নিজেদের আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে পারে।
দশকের পর দশক ধরে চিকিৎসকরা রোগীদের এই ওষুধ লিখে গিয়েছেন এবং তারা তা সেবনও করেছেন। তবে এর মধ্যে বেশিরভাগই উপকার করার বদলে শরীরের গুরুতর ক্ষতি করতে পারে। গলা ব্যথা এবং ক্রমাগত হতে থাকা কাশির দ্রুত নিরাময়ের জন্য বাজারজাত এই মিষ্টি সিরাপগুলো আসলে অ্যান্টিহিস্টামাইনস, ডিকনজেস্ট্যান্টস, এক্সপেক্টোরেন্টসের ককটেলের সঙ্গে চিনি ও রঙের মিশ্রণ।
তাত্ত্বিকভাবে দেখতে গেলে, প্রতিটি উপাদান একটি করে ভূমিকা পালন করে। একটি শ্লেষ্মার নিঃসরণ কমায়, দ্বিতীয়টি কফ বিছিন্ন করে এবং তৃতীয়টি কাফ রিফ্লেক্স (কাশির দমক) স্তিমিত করে। বাস্তবে, এর ইতিবাচক প্রভাব সংক্রান্ত প্রমাণ কমই মেলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাশি কয়েক দিনের মধ্যে আপনা থেকেই ঠিক হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত, সংক্রমণ বা অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কাশি হতে পারে। কাশির সিরাপগুলি দুই ধরনের- একটি ঘুমের ওষুধ যা শিশুকে বিশ্রাম নিতে সহায়তা করে। অন্যটি ব্রঙ্কোডিলেটর যা শ্বাস-প্রশ্বাসকে সহজ করে দেয়। চিকিৎসকরা সাধারণত এর যেকোনো একটি সেবনের পরামর্শ দেন- দুটিই একসঙ্গে সেবনের কথা বলেন না।
মুম্বইয়ের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রাজারাম ডি খারের মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের নাছোড়বান্দা কাশির জন্য সংক্রমণ নয় বরং দায়ী শহরগুলোতে বাড়তে থাকা দূষণ। অ্যালার্জি এবং শ্বাসনালীতে সমস্যার কারণেই এমন ঘটে। ধুলো ও দূষণের প্রতি যখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অত্যধিক প্রতিক্রিয়া দেখায়, তখন অ্যালার্জি দেখা যায়। এই সমস্ত শিশুদের প্রায়শই ঠান্ডা লাগে বা নাক দিয়ে জল পড়ে এবং কাশি হয় যা রাতে বা ভোরের দিকে বাড়ে। প্রতি কয়েক সপ্তাহ অন্তর অন্তর এর পুনরাবৃত্তি হয়।
ডা. খারে জানিয়েছেন, বড় শহরগুলোতে ধুলো এবং ধোঁয়াশা এই জাতীয় পুনরাবৃত্তির সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে। কখনও কখনও হালকা ব্রঙ্কোস্পাজমও (শ্বাস নিতে সমস্যা) দেখা যায়। ডা. খারের মতে এই ধরনের কাশির ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হলো ব্রঙ্কোডিলেটর। এই ওষুধ যা শ্বাসনালীর পথ খুলে দেয়। ইনহেলার বা নেবুলাইজারের মাধ্যমে এই ওষুধ শরীরে যায়। যদিও অনেক ডাক্তারই এখনও কাশির সিরাপের উপরই নির্ভর করেন যা সাময়িক আরাম দেয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের মধ্যে যে কাশি দেখা যায় তা ভাইরাল, সেল্ফ- লিমিটিং (নিজেই ঠিক হয়ে যায়) এবং এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। ফিজিশয়ানদের মতে কোনো কাশির সিরাপই এই সময়সীমা কমিয়ে ফেলতে পারে না। খুব বেশি হলে ক্ষণিকের আরাম দেয়। এর সবচেয়ে খারাপ ফল হতে পারে এর প্রতি আসক্তি, এটি বিষাক্ত হতে পারে এবং ওভারডোজের ঝুঁকিও থাকে।
তিনি বলেন, ‘দু-এক সময় স্বস্তির জন্য প্রেস্ক্রাইব করা ছাড়া আমি সাধারণত সাধারণ কাশি এবং সর্দি-কাশির জন্য কাশির সিরাপ লিখে দিই না। যদি কোনও বাচ্চার ভীষণ কাশি থাকে এবং ঘুমাতে না পারে তবে অস্বস্তি কমানোর জন্য আমি হালকা সিরাপের একটি ডোজ দিতে পারি। এর মূল লক্ষ্য হল কিন্তু স্বস্তি দেওয়া চিকিৎসা নয়, বিশেষত যখন কাশি শুষ্ক হয় এবং ভাইরাল সংক্রমণের সঙ্গে দেখা যায়।’
তাহলে ভারতে কাশির সিরাপ এত ব্যাপকভাবে কেন প্রেস্ক্রাইব করা হয়?
এর একটি কারণ হলো ভারতের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দুর্বল- বিশেষত ছোট শহরগুলিতে ও গ্রামাঞ্চলে। ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণ অবিরাম কাশিকে আরো উস্কে দেয়, তাই এগুলি সাধারণ শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের জন্যও কাশির সিরাপের অপব্যবহার চলতে থাকে। গ্রামাঞ্চলে এই সমস্যা আরও গভীর। গ্রামীণ ভারতে, ৭৫% প্রাথমিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিদর্শন পরিচালনা করেন অনানুষ্ঠানিক সরবরাহকারীরা। প্রায়শই দেখা যায় সেল্ফ-টট (নিজে নিজে শেখা) "আরএমপি" (রেজিস্টার্ড মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশনার) চিকিৎসা করছেন বা আনুষ্ঠানিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ কেউ রোগী দেখছেন।
যেখানে স্থানীয় জনস্বাস্থ্য ক্লিনিক অনেক দূরে, কর্মী সংখ্যা কম বা ক্লিনিক বন্ধ, সেখানে কার্যত এরাই সর্বেসর্বা এবং তাদের কাছে সবচেয়ে বিশ্বস্ত সরঞ্জাম হলো এই কাশির সিরাপগুলি। উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুর শহরে পোস্টিং ছিল শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কাফিল খানের। সেই সময়কার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘যত্রতত্র সিরাপ দিয়ে দেওয়া হতো-এমনকি যাদের ডিগ্রি নেই তারাও দিত।’
দেখা গেছে ছোট শহরে রোগীরা সাধারণ কাশির রাত থেকে রেহাই পেতে যাকে কাছে পান, বা যাকে তার সামান্যতম চিকিৎসাগতভাবে জ্ঞানী বলে মনে হয়, তার উপরই নির্ভর করেন। তা সে অনানুষ্ঠানিক মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশনার হোক বা দোকানদার।
সাবেক ভারতীয় ড্রাগ এক্সিকিউটিভ ও বর্তমানে তিনি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দীনেশ ঠাকুর বলেন, ‘অনেক দরিদ্র রোগী পরামর্শের জন্য স্থানীয় ওষুধের দোকানদারের কাছে যান। তারা ধরে নেন, কাউন্টারের অন্যপ্রান্তে থাকা ব্যক্তি একজন ফার্মাসিস্ট। গ্রামীণ ভারতে দশের মধ্যে দশ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে এই ধারণা ভুল। মনে হতে পারে যে এই সমস্যাটি মূলত ছোট শহর এবং গ্রামীণ অঞ্চলের মধ্যেই সীমিত, কিন্তু তা যে নয় সেটি প্রমাণ করার মতো তথ্য রয়েছে। আমরা বড় শহরের বাসিন্দাদের মধ্যেই একই প্রবণতা দেখতে পাই। পার্থক্য একটাই- ছোট শহর এবং গ্রামীণ অঞ্চলে ওষুধের সরবরাহের গুণমান বড় শহরগুলির তুলনায় আরও খারাপ।’
এই প্রবণতা চলতে থাকার আরেকটি কারণ হলো অসুস্থ শিশুর বাবা-মায়ের উদ্বেগ এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের কম জ্ঞান।
ডা. খানের কথায়, ‘অভিভাবকেরা অনেক কিছু ভালভাবে জানেন না এবং তারা অধৈর্য হয়ে উঠতে পারেন। যদি কোনও শিশুর সর্দি-কাশির কয়েক দিনের মধ্যে না কমে তাহলে তারা প্রায়শই অন্য ডাক্তারের পরামর্শ নেন যিনি কাশির সিরাপ দেবেন।’
ডাক্তারদের মধ্যে কম জ্ঞান সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ডা. খান বলেছেন যে তিনি ‘এমনকি এমডি (ডক্টর অফ মেডিসিন) ধারী শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদেরও বাচ্চাদের অ্যামব্রোক্সল কাশির সিরাপ লিখে দিতে দেখেছেন। এটি ঘন শ্লেষ্মাকে আলাদা করতে সাহায্য করতে পারে, তবে দুই বছরের কম বয়সের বাচ্চারা থুতু ফেলতে পারে না। তাই শ্লেষ্মা ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে, যার ফলে নিউমোনিয়াও হতে পারে। তা সত্ত্বেও এটি প্রেস্ক্রাইব করা হয়।’
বেপরোয়া ব্যবহার বন্ধ করার জন্য ভারতে কাশির সিরাপ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট নীতির প্রয়োজন। প্রয়োজন ডাক্তার এবং অভিভাবকদের মধ্যে দেশব্যাপী সচেতনতারও। এর ব্যবহারগত ঝুঁকিগুলি বাস্তব। মধ্যপ্রদেশে শিশু মৃত্যুর সঙ্গে যোগ মিলেছে এমন কাশির সিরাপ যে চিকিৎসক প্রেস্ক্রাইব করেছিলেন, তিনি তার স্বপক্ষে বলেছিলেন, ‘১৫ বছর ধরে আমি এই কাশির সিরাপই প্রেস্ক্রাইব করেছি।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন